৭৮টি পোশাক কারখানা বন্ধ, কাজে নেই ৩ লাখ শ্রমিক
সাভারের আশুলিয়ায় এবং গাজীপুরে চলমান গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিক্ষোভের মধ্যে শ্রম আইনের ১৩/১ ধারা বলে ৭৮টি পোশাক কারখানার কার্যক্রম স্থগিত করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এসব কারখানায় প্রায় তিন লাখ শ্রমিক নিযুক্ত রয়েছেন। যদিও কর্তৃপক্ষের এমন পদক্ষেপের পর গতকাল শনিবার (১১ নভেম্বর) অনেকটা শান্ত ছিল সামগ্রিক পরিস্থিতি।
এই কারখানাগুলোর মধ্যে ৫২টি আশুলিয়ায়, ২৫টি গাজীপুরের কোনাবাড়িতে এবং একটি রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত।
কারখানার মালিকরা বলেছেন, গত তিন সপ্তাহ ধরে চলতে থাকা ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভের পর এ পদক্ষেপ নিয়েছেন তারা। এই অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু এবং অনেকের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম মান্নান কচি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বন্ধ হওয়া ৭৮টি কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ।
বিজিএমইএ সূত্র জানিয়েছে, বন্ধ কারখানার তালিকায় রয়েছে– হামীম গ্রুপ, নেওয়াজ গ্রুপ, অনন্ত, এনভয়, এএম ডিজাইন, শারমিন, স্টার্লিং, ব্যান্ডো, দ্য রোজ গার্মেন্টস ডিজাইনার লিমিটেড, সেতারা, নাসা, মেডলার, জেনারেশন নেক্সটের মতো বড় বড় পোশাক কারখানা। গাজীপুরে ইসলাম গার্মেন্টস, টুসুকা গ্রুপসহ বড় গ্রুপের কারখানাও বন্ধ রয়েছে।
এছাড়া ওই এলাকার অনেক কারখানায় 'নো ভ্যাকান্সি', 'কর্ম খালি নাই' নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে বিজিএমইএ নতুন কর্মী না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কারখানাগুলোতে।
গতকাল আশুলিয়ার জামগোড়া, ছায়াতলা, নরসিংহপুর ও নিশ্চিন্তপুর এলাকায় কারখানার সামনে নোটিশ দেখে কারখানা বন্ধের খবর না জানা অনেক শ্রমিক বাড়ি ফিরে গেছেন। কিছু শ্রমিক টিবিএসকে বলেছেন, তারা তাদের গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছেন, কারণ কারখানা এখন বন্ধ থাকবে।
শারমীন গ্রুপের শারাফ এমব্রয়ডারি অ্যান্ড প্রিন্টিং লিমিটেডের নোটিশে বলা হয়েছে, 'গত ৩০ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত এ কারখানার শ্রমিকরা বে-আইনিভাবে কাজ বন্ধ রেখে সকালবেলা হাজিরা দিয়ে বের হয়ে চলে যায়। এ ছাড়াও শ্রমিকরা কারখানার ভেতর ও বাইরে ব্যাপক ভাংচুর, মারামারি, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ অরাজকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যাতে কারখানার সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি ও আর্থিক ক্ষতিসাধনও হয়।'
নোটিশে আরও বলা হয়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে গত ১ ও ২ নভেম্বর সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এরপরও শ্রমিকরা ফ্যাক্টরিতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মারামারি ও ভাংচুর অব্যাহত রাখে। এসব ঘটনাকে 'বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬' অনুযায়ী 'অবৈধ ধর্মঘট' হিসেবে উল্লেখ করা হয় এ নোটিশে।
এ কারণে শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারা অনুযায়ী ১১ নভেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে তারা।
নোটিশে উল্লেখ হয়েছে, সামগ্রিক পরিস্থিতি অনুকূলে হলেই কেবল কারখানা পুনরায় চালু করা হবে; এবং তা পরে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
শ্রম আইনের ১৩/১ ধারা অনুযায়ী, অবৈধ ধর্মঘটের কারণে কারখানা বন্ধ রাখতে পারবে কর্তৃপক্ষ। কর্মবিরতি চলাকালীন ওই সময়ের জন্য কোনো বেতন পাবেন না শ্রমিকরা।
তবে বিজিএমইএর একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, অতীতে অনেক কারখানার মালিক আইনের ধারায় তাদের কার্যক্রম স্থগিত রেখেছেন। কিন্তু পরে তারা শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক বিবেচনা করে, শেষ পর্যন্ত বেতন পরিশোধ করেছিলেন।
শ্রমিক গ্রেপ্তার
গাজীপুরের কোনাবাড়িতে শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে শিল্পাঞ্চল পুলিশের ডিআইজি মো. জাকির হোসেন খান জানিয়েছেন, ১২৩টি কারখানায় ভাঙচুরসহ হামলার ঘটনায় গাজীপুরে এ পর্যন্ত ২২টি মামলা হয়েছে এবং এতে গ্রেপ্তার হয়েছেন অন্তত ৮৮ জন। আর সাভারের আশুলিয়ায় ৭টি মামলায় এ পর্যন্ত অন্তত ৪ জন গ্রেপ্তার হওয়ার খবর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে।
অবশ্য শ্রমিক নেতারা বলছেন, গ্রেপ্তারের সংখ্যা আরও বেশি। তাদের মতে, আশুলিয়ায় একটি কারখানার কমপক্ষে ১১ জন শ্রমিক গ্রেপ্তার হয়েছেন।
সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কারখানা বন্ধ, শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ কিংবা মামলা ও হামলা এবং শ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোাঁজার মাধ্যমে শ্রমিক আন্দোলনকে ঠেকানোর অপকৌশল চলছে।"
গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের ভাইস প্রেসিডেন্ট জলি তালুকদার টিবিএসকে বলেন, "মালিকপক্ষ নিজেরাই বলেছেন, যারা কারখানায় হামলা করেছে, তারা শ্রমিক নন। অথচ আশুলিয়ায় একটি কারখানার ১১ জন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরও অস্থির, অস্বাভাবিক হয়ে উঠবে।"
'গ্রেপ্তার, হামলা, মামলা (শ্রমিকদেরকে) শিল্পের জন্য কল্যাণকর নয়'– উল্লেখ করে তিনি বলেন, "যারা শ্রমিক হত্যা করেছে, তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে। কাজের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে আলোচনা করতে হবে, মজুরি বাড়াতে হবে।"
আশুলিয়া থানায় নতুন চারটি মামলার আগের তিন মামলায় প্রায় দেড় হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। নতুন চারটি মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৬ জনকে। অজ্ঞাতনামা কতজনকে আসামি করা হয়েছে তা শিল্প পুলিশ বা আশুলিয়া থানা পুলিশ নিশ্চিত করতে পারেনি।
গাজীপুরে ২২টি মামলায় শ্রমিকের সংখ্যা সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেনি শিল্প পুলিশ। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, হামলাকারীদের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হতে না পারায় তাদেরকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। চারটি থানায় মামলা দায়ের হয়েছে। ফলে আসামির প্রকৃত সংখ্যা এখনো জানা যায়নি।
শিল্প পুলিশ-১ (এসপি, আশুলিয়া) এর সুপারিনটেনডেন্ট সারোয়ার আলম টিবিএসকে বলেন, "আশুলিয়ায় একটি মামলায় ১৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বাকি মামলার আসামিরা অজ্ঞাত।"
মালিকদের দোষারোপ করছেন শ্রমিক নেতারা
এদিকে, পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ, শ্রমিক নিয়োগ স্থগিত, শ্রমিকদের গ্রেপ্তার, এমনকি শ্রমিকদের বাড়িতে পুলিশি অভিযানসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছেন শ্রমিক নেতারা। তারা বলছেন, এসব 'অপকৌশল' এর মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ তাদের যৌক্তিক আন্দোলনকে এড়িয়ে যেতে চাইছে।
অবশ্য 'আন্দোলন ঠেকাতে অপকৌশলের' অভিযোগে অস্বীকার করেছে মালিকপক্ষ।
বিজিএমইএ নেতা এস এম মান্নান কচি টিবিএসকে বলেন, "অপকৌশলের প্রশ্নই আসে না। কারখানা বন্ধ রাখার করণে তো মালিকেরও বিপুল ক্ষতি হচ্ছে। তাহলে কি আমি নিজের পেটে নিজে ছুরি মারবো?"
দাবিতে অনড় শ্রমিকরা
কারখানা বন্ধ হয়ে গেলেও শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে অনড় রয়েছেন।
শনিবার সকালে শারমিন গ্রুপের একটি পোশাক কারখানার একজন অপারেটর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মালিক কারখানা বন্ধ করেছে, আবার যখন ঠিক মনে করবে খুলে দিবে। তবে আমাদের দাবি যেটি ছিল, এখনও সেটি আছে। আমাদের দাবি হেলপারদের অন্তত ১৭ হাজার টাকা ও অপারেটরদের মজুরি যেন অন্তত ২৩ হাজার টাকা করা হয়।"
এসময় নিজের দাবির পক্ষে অনড় থাকার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে এই কর্মী বলেন, "বর্তমান বাজারে সাড়ে ১২ হাজার টাকায় কি চলা যায়? বেতন নিয়ে সমস্যা হলে আমাদের বেতন বাড়াতে হবে না, আপনারা জিনিসপত্রের দাম কমান, বাসাভাড়া কমান, সার্ভিস কোয়ার্টার খুলে দেন আর লাঞ্চের ব্যবস্থা করুন। আমাদের এই কষ্টটাই তো কেউ বুঝলো না। আমার দুটো সন্তান আছে। এই টাকায় কিভাবে সংসার চালাই?"
হামীম গ্রুপের সামনে অপেক্ষারত রিফা নামে একজন শ্রমিক টিবিএসকে বলেন, "৫ বছর আগে জিনিসপত্রের যেই দাম ছিলো, এখন কি তা আছে? আপনারা বেতন বাড়াচ্ছেন কিন্তু কত টাকা বাড়লো? এই বেতনে যদি চলা না যায় তাহলে বাড়তি বেতন দিয়ে কী হবে? বেতন যদি আর বাড়াতে না পারে তাহলে সব জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দিক, অন্যথায় আমাদের মজুরি আরও বৃদ্ধি করতে হবে এটাই আমাদের দাবি।"
এদিকে, গত ৩০ অক্টোবর আশুলিয়া ও গাজীপুরের কয়েকটি শিল্পাঞ্চলে পুলিশ ও তৈরি পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত দুইজন নিহত ও প্রায় ৪০ জন আহত হয়েছেন।
কমপক্ষে ২০,০০০ টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভ সত্ত্বেও, গত ৭ নভেম্বর সরকার কারখানার মালিকদের প্রস্তাবের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সাড়ে ১২,০০০ টাকায় নির্ধারণ করে ন্যূনতম মজুরি।
মঙ্গলবার তৈরি পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের ষষ্ঠ সভা শেষে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মজুরি ৮ হাজার টাকা থেকে ৫৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
শ্রমিক সংগঠনগুলির একাংশ নতুন ঘোষিত এই মজুরি প্রত্যাখ্যান করে। তাদের দাবি, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে এই মজুরিতে তাল মেলাতে ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। অনেকে আবারও নতুন মজুরি নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন, আবার অনেকে এখানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের জন্যও আবেদন জানিয়েছেন।