চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের ব্যয় বাড়ল ৫৪%, মেয়াদ বাড়ল আরও ৩ বছর
চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৫৪ শতাংশ বাড়ানোর পাশপাশি প্রকল্পটি বাস্তাবায়নের মেয়াদও আরও তিন বছর বাড়ানো হয়েছে। এতে চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘ জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাওয়ার রাস্তা আরও কিছুটা লম্বা হলো।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)-এর তথ্যমতে, ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পটি (সিডব্লিউআরপি) ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) অনুমোদন পায়। ২০২০ সালের জুনের শেষ হওয়ার কথা ছিল এটি।
তবে প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই দফা বাড়িয়ে ২০২৩ জুন পর্যন্ত করা হলেও কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৭৬ শতাংশ।
প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৩৬টি খাল সংস্কার, ড্রেনেজ নির্মাণ, গার্ডার ব্রিজ, কালভার্ট এবং বন্যার পানি সংরক্ষণের জন্য জলাধার তৈরি।
সেনাবাহিনীর ইঞ্জনিয়ারিং ব্রিগেড দ্বারা বাস্তবায়িত হতে থাকা প্রকল্পটি ভুল নকশা এবং সাম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই হাতে নেওয়ায় শুরু থেকেই প্রশ্ন উঠে আসছিল।
তহবিল বৃদ্ধিতে এক বছরেরও বেশি সময় দেরি হওয়ায় প্রকল্পের অগ্রগতি আরও বাধাগ্রস্ত হয়।
এছাড়া, কাজের মাঝামাঝিতে সাম্ভাব্যতা সমীক্ষা করে ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ১০ হাজার ৪২০ কোটি টাকার সংশোধিত প্রস্তাবিত প্রকল্প ব্যয় (ডিপিপি) উপস্থাপন করে সিডিএ।
এদিকে, ব্যয়ের যৌক্তিকতা নির্ণয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি তা কমিয়ে ৯ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা নির্ধারণ করে। দ্বিতীয় দফায় কাটছাঁট করে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট ব্যয় কমিয়ে ৮ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা নির্ধারণ করে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় হতে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তবে প্রকল্পটির বর্ধিত ব্যয় দিতে নারাজ ছিল অর্থ বিভাগ।
বর্ধিত ব্যয়ের অর্ধেক সিডিএকে নিজস্ব তহবিল থেকে বহন করতে বলা হয়, যা সিডিএর সামর্থ্যের বাইরে। এসব কারণে দীর্ঘদিন জটিলতার মধ্যে পড়েছিল প্রকল্পটি।
বর্তমানে প্রকল্পের বর্ধিত ৩ হাজার ১২ কোটি ৫৭ লাখ টাকার মধ্যে ১ হাজার ৫০৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে থেকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাকি ১ হাজার ৫০৬ কোটি ২৮ লাখ টাকার অর্ধেক, অর্থাৎ ৭৫৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা সরকারি ঋণ পাবে এবং একই পরিমাণ নিজস্ব তহবিল থেকে দিতে হবে।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই নেওয়া হয়েছিল প্রকল্পটি
সাম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই ২০১৭ হাতে নেওয়া হয় প্রকল্পটি। ছিল না যথাযথ পরিকল্পনাও। উপেক্ষা করা হয়েছিল চট্টগ্রামের ১৯৯৫ সালে মহাপরিকল্পনা।
ফলে প্রকল্পের কাজ ৭৬ শতাংশ শেষ হলেও নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে কোনো সুফল মেলেনি। গত বর্ষা মৌসুমে কয়েক দফা ডুবেছিল পুরো নগরী। সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছিল মানুষ।
বিশেষজ্ঞদের মত, তড়িঘড়ি করে নেওয়া প্রকল্পটিতে বিশেষজ্ঞের মতামত ছিল না। সাম্ভাব্যতা যাচাই না করায় প্রকল্পের কাজ শুরুর পর ঘষামাজা করতে হয়েছে নকশায়। ফলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। সক্ষমতা না থাকার পরও সিডিএকে দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করানোর ফলে পদে পদে জটিলতা দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে চট্টগ্রাম সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকলেও বিষয়টি বিবেচনা নেওয়া হয়নি।
গত ১৯ আগস্ট চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত এক গোল টেবিল বৈঠকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, "জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএর তৎকালীন চেয়ারম্যানের আমলে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই জোড়াতালির মাধ্যমে এই প্রকল্প নেওয়া হয়। আসলে জলাবদ্ধতা প্রকল্প বাস্তবায়নে এই সংস্থার সক্ষমতাও ছিল না। যোগ্যতা অর্জনের আগেই সিডিএকে প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। এখন সরকারের ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে চট্টগ্রামের মানুষকে।"
নগরবাসীর অভিযোগ, দখল হয়ে যাওয়া খাল উদ্ধার না করে উল্টো খালে দেওয়াল দিয়ে সংকোচিত করা হয়েছে। ফলে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি দ্রুত নামতে পারেনি।
অন্যদিকে, প্রকল্পের কাজ শুরুর পরও অনেক অব্যস্থাপনা ছিল চোখে পড়ার মত। খোলা নালায় পড়ে কমপক্ষে ৩ জনের মৃত্যু হয়।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া এ পরিকল্পনায় একাধিক ত্রুটি তুলে ধরেন, যার ফলে শহরের দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা নিরসন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রকল্পে যত ত্রুটি
মূলত চট্টগ্রাম ওয়াসার ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানের ওপর ভিত্তি করে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল। এটি নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনার মধ্যে প্রকল্প পাশের প্রায় ১ বছর পর সম্ভাব্যতা যাছাই শুরু করে সিডিএ।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে নগর উন্নয়জন কর্তৃপক্ষ। একই বছর ২৮ এপ্রিল নালা-নর্দমা পরিষ্কারের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ শুরু করে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং বিগ্রেড। পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসনে পূর্ণাঙ্গ জরিপ ও সমীক্ষার জন্য পরামর্শক সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসকে (সিইজিআইএস) নিয়োগ দেয় সেনাবাহিনী।
এতে বিস্তারিত সাম্ভাব্যতা সমীক্ষায় নকশা ও কাজে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এছাড়া চট্টগ্রামের পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে মূল সংশোধিত ডিপিপিতে নির্ধারিত নকশার বেশ পরিবর্তন আনা হয়।
নগরীর খালের সংখ্যা ৫৭টি হলেও প্রকল্পে মাত্র ৩৬টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ৩৬টি খালের পাড়ে প্রতিরোধ দেওয়াল নির্মাণের প্রস্তাব থাকলেও ভবন ও রাস্তা রক্ষার বিষয়ে মূল নকশায় কোনো পরিকল্পনা ছিল না সিডিএর। ফলে এটিও যুক্ত হয়। ১৫ কিলোমিটার নালা নির্মাণ বাড়িয়ে ৯০ কিলোমিটার করা হয়। কাদা অপসারণের পরিমাণও বাড়ানো হয়। টাইডাল রেগুলেটর, সিল্ট ট্র্যাপের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নকশাও পরিবর্তন করা হয়।
অন্যদিকে, সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বাড়ায় প্রতিবছর নগরীর নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। কিন্তু জোয়ারের পানি আটকাতে প্রকল্পটির আওতায় সব খালের মুখে টাইডাল রেগুলেটার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একইভাবে জোয়ারের সময় খালের মুখ বন্ধ থাকলে নগরীর বৃষ্টির পানি কীভাবে নিষ্কাশন হবে– এর কোনো ব্যবস্থা ছিল না এই প্রকল্পে। যদিও পরে মাত্র চারটি জলারধার নির্মাণ করা হবে বলে জানায় সিডিএ। বর্তমানে জোয়ার ও বৃষ্টির পানি একসাথে হলে নগরীর প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে যায়।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান টিবিএসকে বলেন, "সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্পের সুফল পায়নি মানুষ। প্রকল্পের মূল ত্রুটি ছিল– ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা অমান্য করে প্রকল্প হাতে নেওয়া, প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি, পাহাড়ি বালু আটকাতে পলিফাঁদ নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত না করা। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সংস্কারে অনেক রাস্তার উচ্চতা বাড়ায় বাড়িঘর ও দোকানপাট নিচু হয়ে গেছে। এসব বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।"
জলাবদ্ধতা প্রকল্পের বিষয়ে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস টিবিএসকে বলেন, "চট্টগ্রাম ওয়াসার ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানের ওপর ভিত্তি করে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়েছে। ওয়াসা কতুটুক গভীর স্টাডি করেছে, সেটা আমরা বলতে পারবো না।"