অনলাইনে ঋণের ফাঁদ পেতে প্রতারণা, ব্যবহার করা হচ্ছে বিশ্ব ব্যাংকের নাম-লোগো
বিশ্বব্যাংকের নাম ও লোগো ব্যবহার করে ফেসবুক পেজে দ্রুত ও সহজ শর্তের ঋণের প্রলোভন দিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে কয়েকটি প্রতারক চক্র। এসব চটকদার অফারের ফাঁদে পড়ে অনেক মানুষ ইতিমধ্যে মোটা অঙ্কের টাকা খুইয়েছেন।
উদাহরণ হিসেবে 'ডব্লিউবি বিডি সার্ভিস' নামের একটি ফেসবুক পেজের কথা বলা যাক। পেজটি বিজ্ঞাপন দিচ্ছে: 'ব্যবসা শুরু করার জন্য বা ব্যক্তিগত কারণে আপনার কি ঋণের প্রয়োজন? বিশ্বব্যাংক নিয়ে এল দ্রুত, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ লোন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি ফোটাতে আমাদের আপ্রাণ প্রচেষ্টা।'
'জিনি এ' নামের আরেকটি ফেসবুক পেজেও একই ধরনের বিজ্ঞাপন দেখা যায়।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, এসব পেজের 'সাইন আপ' বা 'অ্যাপ্লাই' বাটনে ক্লিক করলেই একটি অ্যাপ ডাউনলোড করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। অনলাইনে একটা ফরম পূরণ করার পর আগ্রহী ঋণগ্রহীতাকে দেওয়া হয় একটি হোয়াটসঅ্যাপ লিঙ্ক। ওই লিঙ্কে ক্লিক করলেই চলে যায় একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরের চ্যাট বক্সে।
এই চ্যাট বক্সে প্রবেশ করার পর ভুক্তভোগীদের নিবন্ধন ফি, প্রসেসিং চার্জ এবং সরকারি করের মতো নানা ছুতোয় ৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। বিকাশের মাধ্যমে এই অর্থপ্রদান সম্পন্ন করলে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ঋণ অনুমোদনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
ডব্লিউবি সার্ভিসেস নামের পেইজটির ফাঁদে পড়ে গাজীপুরের পোশাক শ্রমিক আলমগির হোসেন খুইয়েছেন সাড়ে ৭ হাজার টাকা।
গল্প ভিন্ন হলেও টাকা হাতিয়ে নেয়ার কৌশল ছিল প্রায় একই। তার ক্ষেত্রেও ব্যাবহার করা হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর। রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ ৫ হাজার ও ট্রান্সফার ফি বাবদ আড়াই হাজার টাকা বিকাশে নেওয়ার পর তার কাছে আরও টাকা চাইলে সন্দেহ হয় আলমগিরের। পরে তিনি তার দেওয়া টাকা ফেরত চাইলে ব্লক করা হয় তাকে।
আলমগির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বিশ্বব্যাংকের নাম ও লোগো দেখে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। তাই টাকা পাঠাতে দ্বিধা বোধ করিনি। যে বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠিয়েছিলাম, সেই নম্বরে কল দিয়ে দেখি নম্বর বন্ধ। বুঝতে পারি, আমি প্রতারণার শিকার হয়েছি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আমার মতো অনেকেই এসব পেজের প্রতারণার শিকার হয়েছেন।'
এ ধরনের প্রতারণামূলক সব পেজ অবশ্য বিশ্বব্যাংকের নাম ও লোগো ব্যবহার করে না। টিবিএসের অনুসন্ধানে অন্তত ১৫টি পেজের সন্ধান পাওয়া গেছে যারা এভাবে সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়ার লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে।
এরকম কয়েকটি পেজ হচ্ছে: ফিউচার লেন্ডিং, বোরো বক্স, বোরো বক্স ০০২, গ্রো ট্রাস্ট, বেস্ট কার্ডস ইন বাংলাদেশ, মানি লায়ন, সিআইবিএম লোন অভ বাংলাদেশ, বিগ ভুয়া এএ, জেফরি রস, জিনি এ, ম্লাদিলিকোভা২, ডব্লিউবি বিডি সার্ভিসেস এবং এএসডি।
এর মধ্যে 'সিআইবিএম লোন বাংলাদেশ অভ অনলাইন' পেজটি শুধু নারী উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে দিয়েছে বিশেষ সুবিধা।
প্রতারণার শিকার বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী টিবিএসকে বলেছেন যে পেজগুলোর নাম আলাদা হলেও, প্রতারণার কৌশল এবং চিহ্নগুলো মূলত একইরকম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋণ দেওয়ার আড়ালে মুনাফা করার মধ্যেই এই প্রতারকরা তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখে না। অ্যাপের মাধ্যমে তারা গ্রাহকদের মোবাইল ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যায় এবং তাদের কাছ থেকে ব্যক্তিগত ছবি ও তথ্য বের করে ব্ল্যাকমেইল করে।
১ লাখ টাকা ঋণের আশায় ৭৫ হাজার টাকা খোয়ালেন
মানি লায়ন নামের একটি পেজে ক্লিক করে মৌলভীবাজারের শুঁটকি ব্যবসায়ী আল আমিন প্রতারণার শিকার হয়ে মাত্র ১ লাখ টাকা ঋণ পাওয়ার লোভে খুইয়েছেন ৭৫ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, 'ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ফেসবুক মানি লায়ন নামে একটা পেজে বিনা জামানতে স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি কিস্তিতে ঋণের বিজ্ঞাপন দেখে আশাবাদী হয়েছিলাম। লিঙ্কে ঢুকতেই একটা অ্যাপ ডাউনলোড করার পর সেখানে একটি অ্যাকাউন্ট করতে বলে। তারপর আমার মেসেঞ্জারে একটা হোয়াটসঅ্যাপ লিঙ্ক পাঠানো হয়। সেখানে ক্লিক করতেই মানি লায়ন থেকে মোস্তাকিম নামে একজন আমাকে স্বাগত জানিয়ে মাত্র ৬ শতাংশ সুদে ১ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। আমি ১ লাখ টাকা ঋণ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করি।
'এরপর আমার ভোটার আইডি কার্ড ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর নিয়ে আমার জন্য মানি লায়নের অ্যাপে একটি অনলাইন ওয়ালেট করে দেয়া হয়। এরপর একটি বিকাশ এজেন্ট নম্বর দিয়ে আমাকে ৫ হাজার টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি ক্যাশ পাঠাতে বলে। টাকা পাঠানোর পর আমার মানি লায়ন অ্যাপের ওয়ালেটে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা জমা করে। টাকাগুলো আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করতে গেলে আমার অ্যাকাউন্ট নম্বর ভুল হয়েছে বলে মেসেজ দেয়।'
আল আমিন বলেন, 'পরে ওই হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগ করলে এই ভুল শোধরাতে হলে আমাকে ৩০ হাজার টাকা জামানত দিতে হবে বলে জানায়। তার কথামতো আবারও ৩০ হাজার টাকা পাঠানোর পর আমার ওয়ালেটে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা দেখিয়ে আমার বিশ্বাস অর্জন করে। কিন্তু এই টাকা তুলতে গেলে শুরু হয় নতুন বাহানা। প্রথমে ইনস্যুরেন্স বাবদ ১০ হাজার টাকা, সরকারি ট্যাক্স-ভ্যাট বাবদ ১০ হাজার টাকা, পরে ট্রান্সফার ফি বাবদ আরও ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর যতক্ষণে আমি বুঝতে পারি তারা আমার সাথে প্রতারণা করছে, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়।
'এরপর আমি ঋণ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে টাকা ফেরত চাইলে তারা আবার লোন ক্যান্সেল ফি বাবদ ৫ হাজার টাকা দাবি করে। এক পর্যায়ে হোয়াটসঅ্যাপে তারা আমাকে ব্লক করে দেয়। এক মাস সময় ধরে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার করে এই টাকা জোগাড় করেছিলাম ঋণটা পাওয়ার আশায়। উল্টো আমি এখন আরও বেশি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।'
টিবিএস এই প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত বিকাশ নম্বরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে, কিন্তু নম্বরগুলো বন্ধ পাওয়া গেছে। বিকাশ নম্বরগুলোর বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে বিকাশের কর্পোরেট কমিউনিকেশন কর্মকর্তা রোকসানা মিলি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বেশ কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে প্রতারণা করার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর ফাঁকি দিতে প্রতারকরা ফেসবুক পেজ বন্ধ করে দেয়। তবে পরে তারা ভিন্ন নামে নতুন পেজ খুলে প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড চালি যায় বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।
সাইবার অপরাধ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার আসিফ মহিউদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'পেজগুলো মূলত নিয়ন্ত্রণ করা হয় দেশের বাইরে থেকে। তবে এদের দেশীয় কিছু এজেন্ট আছে যারা ভুয়া ঠিকানা দিয়ে বিকাশ অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে প্রতারণার বিভিন্ন ধাপে তাদের সহায়তা করে। অভিযোগগুলোর তদন্ত চলছে এবং প্রতারক চক্রের সদস্যদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে আমরা কাজ করছি।'
অনুমোদিত কোনো অনলাইন ঋণদাতা নেই: বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মেসবাউল হক টিবিএসকে বলেন, অনলাইনে ঋণ দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়নি। কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়া বা আর্থিক লেনদেন করার আগে ওই প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অনুমোদিত কি না, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে যাচাই করে নেওয়ার জন্য গ্রাহকদের অনুরোধ জানান তিনি।
তিনি বলেন, 'যেকোনো অননুমোদিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনই ঝুঁকিপূর্ণ।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, 'কেউ কোনো ধরনের প্রতারণা বা অনিয়ম করলে তা তদন্ত করার জন্য বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি উইং কাজ করে। এসব বিষয় তাদের অবগত করলে তারা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়।'
এরকম প্রতারণা থেকে নিরাপদ থাকার উপায়
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ফ্যাক্টচেকার কদরুদ্দিন শিশির বলেন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের প্রথমে বুঝতে হবে অনলাইনে শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি, মোবাইল নম্বর ও ই-মেইল আইডি দিয়ে কোনো জামানত ছাড়া ঋণ দেয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি। আর কোনো গ্রাহকের আয়-ব্যায়ের হিসাব, ঋণের টাকা ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা যাচাই-বাছাই না করে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ দেওয়াটাও বাস্তবসম্মত নয়।
তিনি বলেন, 'ব্যবহারকারীদের বুঝতে হবে, অনলাইনে সহজ শর্তে, কম সুদে মাত্র কয়েক মিনিট বা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঋণ অনুমোদন দেওয়ার বিজ্ঞাপনদাতারা সব প্রতারক। কারণ এদের বাস্তবে কোনো অফিস নেই বা তারা গ্রাহকদের সাথে সরাসরি দেখা করতে চায় না। এদের ওয়েবসাইটের ইউআরএল খেয়াল করলে দেখা যাবে 'এইচটিটিপি'র পরে 'এস' অক্ষরটি থাকে না। তার মানে তাদের ওয়েবসাইট সুরক্ষিত নয়।'
শিশির আরও বলেন, কোনো পেজ থেকে যদি কোনো লিংকে ক্লিক করতে বা অ্যাপ ডাউনলোড করতে বলে, ধরে নিতে হবে তারা প্রতারক। এসব পেজের 'সাইন আপ' বা 'অ্যাপ্লাই' বাটনে ক্লিক করা থেকে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বিরত থাকার পরামর্শ দেন এই ফ্যাক্টচেকার।