এবার নির্বাচনী আমেজ কম ছাপাখানায়, কমেছে পোস্টার ছাপানো
নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দের পরপরই সাধারণত ছাপাখানাগুলোতে দেখা দেয় নির্বাচনের আমেজ। প্রার্থীদের পোস্টার, ব্যানার, লিফলেট ছাপানোর জন্য রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয় ছাপাখানায়। কিন্তু আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়ে গেলেও এবার সেই চিরাচরিত উৎসবমুখর নির্বাচনী আমেজ দেখা যায়নি দেশের ছাপাখানাগুলোতে। এর মূল কারণ দুটি—কিছু বিরোধীদলের নির্বাচন বর্জন এবং প্রচারণার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা।
গত তিন নির্বাচনের থেকে এবারে প্রার্থী সংখ্যা বেশি হলেও বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় প্রেসগুলো তেমন অর্ডার পায়নি বলে দাবি প্রেস মালিকদের। ছাপাখানার মালিকরা বলছেন, এবার বিএনপিসহ বেশ কিছু দল নির্বাচনে না আসায় অর্ডার কমে গেছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ।
তারা বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিপরীতে যেসব স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন, তাদের অধিকাংশই 'ডামি'। এই প্রার্থীরা বেশি পোস্টার-লিফলেট ছাপাবেন না। অন্য ছোট দলের প্রার্থীরা প্রচারণায় খরচ করেন কম।
এছাড়া ডিজিটাল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা বাড়ায় ছাপাখানায় ভিড় কমছে বলেও জানান তারা।
নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে গতকাল। এরপর থেকেই শুরু হয়েছে প্রচারণা। ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের ৪৮ ঘণ্টা আগপর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণা চালানো যাবে।
গতকাল রাজধানীর প্রেসপাড়াখ্যাত ফকিরাপুল এলাকার প্রায় ২০টি ছাপাখানা ঘুরে দেখা যায়, নির্বাচন উপলক্ষে তেমন ব্যস্ততা নেই ছাপাখানাগুলোতে। নতুন বছরের ক্যালেন্ডার, ডায়েরিই ছাপানো হচ্ছে বেশিরভাগ প্রেসে।
ফকিরাপুলের আবরণ প্রিন্টার্সের মালিক মোহম্মদ আনোয়ার হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে সবাই পোস্টার ছাপাত।
তিনি বলেন, 'গত চারটি নির্বাচনে দেখেছি, যখন বিএনপিসহ সব দল নির্বাচনে আসত, তখন প্রতীক বরাদ্দের দিনই সরগরম থাকত প্রেসগুলো। দলীয় প্রতীক যারা পেতেন, তারা আগে থেকেই অর্ডার দিয়ে রাখতেন। আর এখন প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোনো অর্ডার পাইনি এখনও।'
হৃদয় ডিজাইন ফেয়ার-এর ম্যানেজার গোলাম মোস্তফা বলেন, এখন অনলাইনে প্রচারণা চলছে বেশি। হয়তো মঙ্গলবার থেকে কিছু আর্ডার আসতে পারে।
প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান তোফায়েল খান টিবিএসকে বলেন, 'প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন না হওয়ার কারণে পোস্টারটা দরকার নামকাওয়াস্তে। শক্তিশালী দুই দল নির্বাচনে একে আপরে বিপক্ষে লড়লে জনগণকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। তারা পোস্টার ছাপে, লিফলেট ছাপে, জীবনবৃত্তান্ত ছাপে, নির্বাচনের ইশতেহার ছাপে।'
'কিন্তু নির্বাচনে আকর্ষণ না থাকার কারণে পোস্টারের ব্যবহার কমে গেছে। ২০০৮-এর নির্বাচন পর্যন্ত পোস্টারের বাজার ভালো ছিল। এরপর থেকে এ বাজারটা অনেকটা ঠান্ডা হয়ে গেছে।'
একসময় পোস্টারের বাজার ছিল বার্ষিক ৩০০ কোটি টাকা, এখন সেটি ১০০ কোটি টাকার নিচে চলে এসেছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ ৩৯টি দল অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনে দেশের সব প্রান্তের ছাপাখানাগুলোই প্রতীক বরাদ্দের আগেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপিসহ অধিকাংশ দল বয়কট করায় মাত্র ১২টি দল অংশ নিয়েছিল এবং প্রায় অর্ধেকসংখ্যক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেছিলেন। সে বছরও ছাপাখানাগুলোতে কাজের ছাপ তেমন ছিল না।
২০০৮ সালের নির্বাচনে ৩৮টি, ২০০১ সালে ৫৫টি ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ৪২টি দল অংশ নিয়েছিল। তখন বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ সব দলই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।
এছাড়া তখন ডিজিটাল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা না থাকায় ছাপাখানাগুলোতে উপচে পড়া ভিড় থাকত পোস্টার, লিফলেট ছাপাতে।
ঢাকার বাইরের ছাপাখানার অবস্থা
ঢাকার বাইরের ছাপাখানাগুলোতেও নির্বাচনের প্রভাব তেমন পড়েনি।
খুলনার শান্তিধাম মোড়ে ৫টি ছাপাখানা রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম কাকন প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স এর স্বত্বাধিকারী নাসির উদ্দীন বলেন, 'চলমান জাতীয় নির্বাচনর কোনো প্রভাব এ বছর ছাপাখানাগুলোতে পড়েনি। আমার কাছে এ পর্যন্ত কোনো প্রার্থী একটি পোস্টারেরও অর্ডার দেননি।'
খুলনার পিকচার প্যালেস মোডের আরাফাত গলিতে প্রায় ৫০টি ছাপাখানা রয়েছে। সেখানে গিয়েও কোনো ব্যস্ততা দেখা যায়নি।
সোমবার দুপুরে রাজশাহী নিউমার্কেট ও হর্কার্স মার্কেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, হাতেগোনা ৪-৫ প্রেসে নির্বাচনী পোস্টার ও লিফলেট ছাপানোর কাজ চলছে। অন্য প্রেসগুলোর মধ্যে অনেক প্রেসে কোনো কাজ নেই। কিছু প্রেসে অন্য নিয়মিত যে ছাপার কাজ হয়, সেগুলো হচ্ছে। রাজশাহীতে ৬০টির মতো প্রেস রয়েছে।
রাজশাহীর স্বাগতম প্রিন্টিং প্রেসের কর্ণধার স্বাগতম নস্কর জানান, গতবার নির্বাচনের সময় প্রতীক বরাদ্দের আগে থেকে কাজের চাপ শুরু হয়। কিন্তু এবার কাজের চাপ নেই বললে চলে। এ পর্যন্ত তিনজন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর ১০ থেকে ১৫ লাখ হ্যান্ডবিল ও দেড় লাখের মতো পোস্টার ছাপানোর কাজ পেয়েছেন তারা।
বগুড়ার প্রেসপট্টি নামে খ্যাত শাপলা মার্কেটের আল সামাল প্রেসের মালিক ফজলুর রহমান বলেন, 'বগুড়ায় নাটোর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, নওগাঁসহ অন্যান্য জেলার নৌকার পোস্টার ছাপানোর কিছু কাজ পেয়েছি। তবে ইউনিয়ন পরিষদের মতো বেশি চাপ নেই। নৌকার প্রার্থীরা আগে থেকেই পোস্টার ছাপানো শুরু করেছে। এখন কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থীর পোস্টার ছাপানো হচ্ছে।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মৌসুমী অফসেট প্রেসের স্বত্বাধিকারী খায়রুজ্জামান ইমরান বলেন, এবার তারা এখনও কাজ শুরু করেননি। তবে ইতিমধ্যে জেলা আওয়ামী লীগ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে। তবে এরচেয়ে বেশি কাজের আশা ছিল তাদের। বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা ৬-৭ লাখ টাকার কাজ পেয়েছিলেন।
নোয়াখালী জেলা মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতা ও গনি আর্ট প্রেসের স্বত্বাধিকারী রাসেদ ছিদ্দিকী শান্ত জানান, সোমবার পযর্ন্ত তিনি ২ জন প্রার্থীর ১০ হাজার পোস্টারের আদেশ পেয়েছিলেন। অন্য প্রেসগুলোর অনেকেই কোনো অর্ডার পায়নি।
প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আমাদের জেলা প্রতিনিধিরা।