টেকসই প্রবৃদ্ধির পথে হাঁটছে আরও পোশাক কারখানা
টিকে থাকা ও প্রবৃদ্ধির সক্ষমতা — ডিবিএল গ্রুপ-এর কাছে মৌলিক নীতি হিসেবে টেকসইতার সংজ্ঞা এটিই।
পরিবেশ-সচেতন চর্চায় অন্য প্রতিযোগীদের চেয়ে অনেক আগেই এগিয়ে থাকা এ প্রতিষ্ঠানটি নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার জন্য সৌর শক্তির ব্যবহার শুরু করেছে। পাশাপাশি বর্জ্য পানি পরিশোধন ও রিসাইকেলের জন্যও বাস্তবায়ন করছে নানা উদ্যোগ।
২০১৩ সাল থেকে ডিবিএল ধারাবাহিকভাবে সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্ট প্রকাশ করছে। এর মাধ্যমে কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল, জার্মান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন (ডিইজি), ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি), জার্মান ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (জিআইজেড), আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), ও ইউনিসেফ-এর মতো বিশ্বব্যাপী খ্যাতিমান ক্রেতা এবং উন্নয়ন সংস্থার আস্থা অর্জন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
ডিবিএল-এর পথ ধরে এখন টেকসইতার দিকে ঝুঁকছে দেশের আরও এক ডজন পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান।
এ প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্ট প্রকাশ শুরু করেছে। এছাড়া এ ধরনের রিপোর্ট প্রকাশের প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও ২০টি কারখানা।
সামষ্টিক এ প্রচেষ্টাটি আগামী ২০২৫ সালে চালু হতে যাওয়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন'স কর্পোরেট সাসটেইনেবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স ডিরেক্টিভ-এর নির্দেশনার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, আরও বেশি কারখানা এ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবে। তারা জোর দিয়ে বলছেন, ইইউ'র ডিউ ডিলিজেন্স ডিরেক্টিভ পুরোপুরি বাস্তবায়নের পর সরবরাহ চেইনের যেকোনো পর্যায়ে এটির নির্দেশনা মানা না হলে শাস্তির মুখেও পড়তে হবে কারখানাগুলোকে।
সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্ট প্রকাশ করা পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে কিউট ড্রেস ইন্ডাস্ট্রিজ, প্যাসিফিক জিনস, টিম গ্রুপ, ভিয়েলাটেক্স, উর্মি গ্রুপ। মাসকো গ্রুপ এ রিপোর্টিং শুরু করার প্রক্রিয়ার রয়েছে।
'টেকসইতা নিয়ে আমাদের উদ্যোগসমূহ একটি সবুজ, আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, এবং সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল বিশ্ব তৈরিতে আমাদের প্রতিশ্রুতির নমুনা। প্রতিটি পদক্ষেপই আমাদের গ্রহকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, তাই আমি আশা করি এই সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্ট আরও অনেককে অনুপ্রাণিত করবে,' বলেন টিম গ্রুপ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ হিল রাকিব।
টেকসইতা নিয়ে নিজেদের প্রচেষ্টার ওপর আলোকপাত করে প্যাসিফিক জিনস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম তানভীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রতিবেদনটি 'আমাদের ব্যবসার দীর্ঘমেয়াদী অগ্রগতি এবং কর্মদক্ষমতার সার্বিক বিশ্লেষণ' প্রদান করবে। এ পদ্ধতিটি কাঁচামাল এবং বিভিন্ন সম্পদের অনুকূল ব্যবহারে সহায়তা করে বলে জোর দিয়ে উল্লেখ করেন তিনি।
ডিবিএল-এর চিফ সাসটেইনেবিলিটি অফিসার মোহাম্মদ জাহিদুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, 'এখন অনেক ক্রেতাই তাদের সরবরাহকারী কোম্পানির পরিবেশগত, সামাজিক ও গভর্নেন্সের (এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল অ্যান্ড গভর্নেন্স; ইএসজি) চর্চাসমূহ নিয়ে জানতে চায়। এ বিষয়গুলো সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্টে প্রতিফলিত হবে।'
তিনি আরও উল্লেখ করেন, পশ্চিমা গ্রাহকেরা ইএসজি অনুসরণ নিয়ে সতর্ক; তাই এ রিপোর্টটি রপ্তানি-আদেশের বিষয়ে ক্রেতাদের প্রতিষ্ঠান বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিবেচনার সুবিধা দেবে।
জাহিদুল্লাহ বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) আসন্ন ডিউ ডিলিজেন্স নিয়মগুলো ইএসজি চর্চা ও কর্মসক্ষমতার ওপরও আলোকপাত করতে পারে। যেসব প্রতিষ্ঠান সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে, সেগুলো ইইউ দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসায় অগ্রাধিকার পাবে।
তিনি বলেন, ভবিষ্যতে কারখানাগুলোকে তাদের কোম্পানির প্রোফাইল ব্রোশিওর আর প্রকাশ করতে হবে না কারণ তার জায়গা গ্রহণ করবে সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্ট।
কিউট ড্রেস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ এইচ এম মুস্তাফিজ বলেন, 'আমরা প্রায় পাঁচ বছর আগে স্ব-উদ্যোগে সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্ট প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিই। তবে ইইউ'র ডিউ ডিলিজেন্স নিয়মের পর আগামী দিনগুলোতে মানবাধিকার এবং পরিবেশগত ফুটপ্রিন্ট মূল্যায়নের জন্য নিজেদের সনাক্তযোগ্য এবং স্বচ্ছ করতে আরএমজি কারখানাগুলোকে এ রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে।'
'এটি কারখানার ব্র্যান্ডিং উন্নত করার পাশাপাশি আমাদের ন্যাগোসিয়েশন ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে,' বলেন তিনি।
মুস্তাফিজ আরও উল্লেখ করেন, তারা প্রাথমিক পর্যায়ে ডেটা ডিজিটাইজেশনসহ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তবে এখন তারা তাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পথে কম উপাদান ব্যবহার করে চূড়ান্ত পর্যায়ে অপচয় কমানোর ক্ষেত্রে আরেকটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, অপচয়ের হিসেব কাপড়ের বেধের ওপর নির্ভর করে। কাজের আদেশের ওঠানামার কারণে বছরের ব্যবধানে পানি, বিদ্যুৎ এবং কার্বন নিঃসরণ কমানো চ্যালেঞ্জিং রয়ে গেছে।
একই সমস্যার কথা উল্লেখ করে ডিবিএল-এর জাহিদুল্লাহ বলেন, 'আমরা ধীরে ধীরে আমাদের টেকসইতা উন্নত করার চেষ্টা করছি, আমাদের রিপোর্টেও তা স্পষ্ট। তবে কখনও কখনও কিছু বাহ্যিক সমস্যার কারণে এটি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।'
'গ্যাস সরবরাহে নিম্ন চাপের কারণে পোশাক রপ্তানিকারকদেরকে শিপিংয়ের সময়সীমা পূরণের জন্য ডিজেলচালিত জেনারেটর ব্যবহার করতে হয় যা কার্বন নিঃসরণের ফুটপ্রিন্ট বাড়ায়,' তিনি জানান।
মাসকো গ্রুপ-এর নির্বাহী পরিচালক মাহবুব মিল্টন বলেন, গ্রুপটি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজস্ব লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। একইসঙ্গে বিভিন্ন বৈশ্বিক ব্র্যান্ডও কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং তাদের নিজ নিজ লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে টেকসই কাঁচামাল ব্যবহারে অঙ্গীকার করেছে।
গ্রুপটি রিয়েল-টাইম ডেটা ডিজিটাইজেশনসহ টেকসইতা বিষয়ক বেশকিছু উদ্যোগে সক্রিয়ভাবে জড়িত। এই অঙ্গীকারের ওপর জোর দিয়ে মিল্টন বলেন, 'আমরা বর্জ্য, কার্বন নিঃসরণ এবং বিপজ্জনক রাসায়নিকের ব্যবহার কমানোর পাশপাশি সনাক্তযোগ্যতা অর্জন এবং জবাবদিহিতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত রয়েছি।'
'সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে আমাদের সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্ট এসব উদ্যোগের ফলাফল বিস্তৃতভাবে প্রদর্শন করবে। এ সক্রিয় পদ্ধতিটি একটি স্ব-অডিটের মতো, যা ক্রেতা বা ব্যবসায়িক অংশীদারদের কাছ থেকে কোনো ধরনের অনুসন্ধানের আহ্বানের আগে নিজে থেকেই পরিচালিত হয়,' তিনি আরও জানান।
বিজিএমইএও উদ্যোগ নিচ্ছে
পোশাক রপ্তানিকারকদের নেতৃস্থানীয় অ্যাসোসিয়েশন হিসেবে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-ও ২০২০ সাল থেকে এর সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্ট প্রকাশ করছে।
'আমরা আমাদের শিল্পকে আরও সহনশীল করতে এটিকে পরিবর্তিত এবং উন্নততর করেছি। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার পাশাপাশি আমাদের পোশাকশিল্প সক্রিয়ভাবে টেকসইতায় অবদান রাখছে। আমাদের অনেক সদস্য ইতোমধ্যেই সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্ট প্রকাশ করছে,' বলেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।
তিনি বলেন, বিজিএমইএ এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এর 'টেকসই কৌশলগত রূপকল্প ২০৩০' ঘোষণা করেছে। পোশাক শিল্প খাতের লক্ষ্য কার্বন নিঃসরণ, শক্তি এবং ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানো, এবং টেকসই কাঁচামাল, জিরো ডিসচার্জ অফ হ্যাজার্ডাস কেমিকেলস (জেডডিএইচসি) ও নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা।
শেখ এইচ এম মুস্তাফিজ বিজিএমইএ সাসটেইনেবিলিটি স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, অ্যাসোসিয়েশন তাদের সদস্য কারখানাগুলোর তথ্যের ভিত্তিতে আগামী বছর থেকে একটি দ্বিবার্ষিক সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্ট প্রকাশ করবে। এর আগে প্রতিবেদনটি কেবল সমিতির নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে প্রকাশিত হতো।
বাংলাদেশ ২০৬টি সবুজ কারখানা রয়েছে। এগুলো এনার্জি ও পানির ব্যবহার এবং কার্বন নিঃসরণের ফুটপ্রিন্ট কমানোর মতো সবুজ উদ্যোগের জন্য ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) থেকে সার্টিফিকেটও পেয়েছে।
সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্টে থাকা অঙ্গীকার
এ রিপোর্টে টেকসই এবং দায়িত্বশীল ব্যবসায়িক অনুশীলন এবং এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কার্যকর ইএসজি উদ্যোগ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিও তুলে ধরা হয়।
সমন্বিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গ্লোবাল রিপোর্টিং ইনিশিয়েটিভ (জিআরআই)-এর সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্টিং ফ্রেমওয়ার্কের অনুকরণে পোশাক রপ্তানিকারকেরা তাদের টেকসইতার পারফরম্যান্স প্রকাশ করার জন্য এ উদ্যোগ নিয়েছেন।
বিশ্বব্যাপী জিআরআই-এর রিপোর্টিং কাঠামো সকল অংশীজনদের দ্বারা স্বীকৃত ও প্রশংসিত এবং বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এটিকে গ্রহণ করেছে।
সম্প্রতি কিছু রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান তাদের সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্ট তৈরিতে সাসটেইনেবিলিটি অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ডস বোর্ড (এসএএসবি)-এর আদর্শমান অনুসরণ করেছে।
এসএএসবি স্ট্যান্ডার্ডস প্রতিষ্ঠানকে টেকসইতা-সম্পর্কিত ঝুঁকি এবং সুযোগ সম্পর্কে শিল্প-ভিত্তিক তথ্য প্রদানে সক্ষম করে তোলে।
ইইউ'র ডিউ ডিলিজেন্ট ডিরেক্টিভ কী?
ইইউ আইনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রস্তাবিত এই কর্পোরেট সাসটেইনেবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স ডিরেক্টিভ এ অঞ্চলের ২৭টি দেশে ব্যবসা পরিচালনা করা ইইউ এবং নন-ইইউ উভয় ধরনের কোম্পানিকে তাদের কার্যক্রম, সহায়ক সংস্থা এবং মান শৃঙ্খলজুড়ে পরিবেশগত ও মানবাধিকার বিষয়ে বাধ্যতামূলকভাবে ডিউ ডিলিজেন্স মেনে চলার একটি নির্দেশিকা।
জার্মানি ইতোমধ্যেই এ বছরের শুরু থেকে একই ডিউ ডিলিজেন্স আইন কার্যকর করেছে। ইইউ ডিউ ডিলিজেন্স অ্যাক্ট বৃহত্তর ইইউ এবং নন-ইইউ কোম্পানিগুলোর ওপর আরোপিত হবে। আনুমানিক হিসাবে দেখা গেছে, এ নির্দেশিকাটি ১৩ হাজার ইইউ প্রতিষ্ঠান এবং চার হাজার নন-ইইউ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হতে পারে। ছোট এবং মাঝারি আকারের ব্যবসাগুলোকে এতে টেকনিক্যালি ছাড় দেওয়া হলেও এগুলো বড় কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করার সময় এ নির্দেশিকার কিছুটা আওতায় আসবে।