আওয়ামী লীগের 'স্বতন্ত্রপ্রার্থী কৌশল' কি হিতে বিপরীত হলো!
অংশগ্রহণমূল নির্বাচন করা ও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়ানোর কৌশল হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে নমনীয়তা দেখিয়ে অনেকটা বিপাকে পড়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপিবিহীন নির্বাচনে বেশিরভাগ আসনেই দলীয় প্রার্থীর বাইরে দলেরই আরও এক বা একাধিক নেতা নেমেছেন ভোটের লড়াইয়ে। এতে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে তৈরি হচ্ছে কোন্দল; বাড়ছে অভ্যন্তরীণ সংকট।
পাশাপাশি নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচারকাজ শুরু হলে গত দুই দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের মধ্যেও হামলা-ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
গত ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারকাজ শুরু হওয়ার পর গতকাল পর্যন্ত অন্তত ৩০ জায়গায় ক্ষমতাসীন দলটির প্রার্থী এবং দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনার খবর পাওযা গেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিক। আহতদের মধ্যে প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মী।
২৬৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সাথে প্রায় ১৩০টি আসনে দলের প্রার্থীর বিপক্ষে দলের এক বা একাধিক শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন। এরমধ্যে ৮০টি আসনে দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। দলের মনোনয়ন বঞ্চিত ২৭ বর্তমান এমপি, দুই ডজন উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরভা মেয়র এবং স্থানীয় প্রভাবশলী নেতারা এসব আসনে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে– মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের বিপরীতে যারা স্বতন্ত্র হিসেবে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন, তাদের কেউ সাবেক সংসদ সদস্য, কেউ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ ছেড়েছেন। আবার অনেকেই দলের স্থানীয় পর্যায়ে পদধারী নেতা। এসব আসনে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিজ দলের পদধারী শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। দলের মনোীন ও স্বতন্ত্র উভয় প্রার্থী শক্তিশালী হওয়ায় নির্বাচনে প্রচারকাজে কেউ কাউকে ছাড় দিতে চাচ্ছেন না। ফলে নিজেদেরে মধ্যে সংঘাত বাড়ছে।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বড়ানোর জন্য দলের মধ্যে থেকে 'ডামি প্রার্থী' হওয়ার জন্য নোকর্মীদের নির্দেশ দেন দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এখন এসব ডামি প্রার্থী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তারা এখন জেতার জন্য মরণপণ লড়াই শুরু করেছে।"
তিনি বলেন, "এখন আওয়ামী লীগের যেসব নেতারা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করছেন, তাদের সকলেই দলের মনোনয়ন বঞ্চিত। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই স্থানীয়ভাবে অনেক প্রভাবশালী। যাদের নিজস্ব অনুসারী রয়েছে। আবার যারা দলের প্রার্থী তারাও শক্তিশালী। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে দেশের প্রায় সকল আসনেই দলের মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে দলের স্বতন্ত্রদের লড়াই হচ্ছে এবং এ নিয়ে সংঘাত তৈরি হচ্ছে।
সংঘর্ষ ও উত্তেজনা নির্বাচনী এলাকায়
মুন্সিগঞ্জ-৩ (সদর ও গজারিয়া) আসনের প্রতীক বরাদ্দের পর আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান এমপি মৃণাল কান্তি দাস ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার সদ্য পতদ্যাগী মেয়র মোহাম্মদ ফয়সালের সমর্থকদের মধ্যে গত ১৮ ডিসেম্বর সংঘর্ষ হয়েছে। যেখানে দলীয় মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকেদর ৭ জন আহত হয়েছেন।
এছাড়াও ২০ ডিসেম্বর দলীয় প্রার্থী মৃণা কান্তির একটি ইউনিয়ন নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করার অভিযোগ উঠেছে সতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সালের সমর্থকদের বিরুদ্ধে।
জানা যায়, দলের স্বতন্ত্র প্রর্থী মোহাম্মদ ফয়সালের বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ মুন্সিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। মা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, চাচা সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, চাচী জেলা মহিলা আওয়ামী লগের সভাপতি এবং চাচাতো ভাই সদর উপজেলা যুবলীগের সদ্য বহিষ্কৃত সভাপতি।
স্থানীয় একজন নেতা জানান, স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সাল একতাটাই প্রভাবশালী, অনেক জায়গায় নৌকার প্রার্থী কোণঠাসা হয়ে পড়েছে এবং প্রতিনিয়ত নৌকার প্রচারকাজে বাধা দিচ্ছে।
ময়মনসিংহ-৩ গৌরীপুর আসনে, দলের প্রার্থী হলেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক বিশেষ সহকারী (মৃত) শাকিল আহমেদের স্ত্রী অ্যাডভোকেট নিলুফার আনজুম পপি। ওই আসনে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফ হাসান অনু হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
এছাড়া ময়মনসিংহ জেলা ও গৌরীপুর উপজেলার বিভিন্ন স্তরের আরও চারজন আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন। এই আসনে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক অন্তঃকোন্দল শুরু হয়েছে। ফলে নৌকা প্রতীকের জয়লাভ বেশ কঠিন হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং বর্মান এমপি মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্যাহ। এর আগে একাদশ ও দশম জাতীয় নির্বাচনে কাজী জাফর উল্যাহ হেরে যান নিক্সনের কাছে।
এই আসনের স্বতন্ত্র এবং দলীয় প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে গত দুই দিনে তিনটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আহত হয়েছে ৪ জন। এই আসনেও নৌকার জয় বেশ কঠিন।
ফরিদপুর সদর আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শামীম হক ও দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী এক আজাদের সমর্থকদের মধ্যে বুধবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এখানে দুজনেই বেশ প্রভাশালী।
ঢাকা-১৯ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার মো. তৌহিদ জং (মুরাদ)। গাজীপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম। গাজীপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসানের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন আওয়ামী লীগ নেতা কাজী আলিম উদ্দিন ও যুবলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম।
শিক্ষামন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি চাঁদপুর-৩ আসনের (সদর ও হাইমচর) বর্তমান সংসদ সদস্য। এবারও তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য শামছুল হক ভূঁইয়া। তার পক্ষে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের একাংশ। আরেকাংশ দীপু মনির পক্ষে।
জামালপুর-২ আসনে (ইসলামপুর উপজেলা) আওয়ামী লীগের প্রার্থী ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা জিয়াউল হক ও সাজাহান আলী মণ্ডল।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান টিবিএসকে বলেন, নির্বাচনের একটা উৎসব সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে ছোটখাটো কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে, এ বিষয়ে দলের কেন্দ্র নজর রাখছে।
দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসবে কিনা, এ বিষয়ে তিনি বলেন, "আমরা এখনো নজর রাখছি। দলের যেসব স্বতন্ত্র প্রার্থী বাড়াবাড়ি করছে বা করবে, তাদের বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তবে কী সিদ্ধান্ত আসবে, সেটি নির্বাচনের কয়েকদিন আগে জানা যেতে পারে। দলের সকল নেতাকর্মীকে সংযত হয়ে নির্বাচনের প্রচারকাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন দলীয় প্রধান।"