নির্বাচনী সহিংসতা ও আচরণবিধি লঙ্ঘন কমছে না
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দোরগোড়ায় চলে এসেছে, তবু প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রচারশিবির ও মিছিলে হামলা, কর্মীদের মারধর, হুমকি ও সংঘাত এবং আচরণবিধি লঙ্ঘন থামছে না।
গত ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা শুরুর প্রথমদিন থেকে রোববার (২৪ ডিসেম্বর) পর্যন্ত সাত দিনে প্রায় ৪০টি আসনে অর্ধশতাধিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এতে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৪ জনের, আহত হয়েছেন প্রায় দেড়শতাধিক।
এসব সংঘাতে জড়াচ্ছেন মূলত ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নৌকার প্রার্থীর সমার্থকদের দ্বারা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থক ও নির্বাচনী প্রচারশিবিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়া তফসিল ঘোষণার পর থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটিগুলো সারা দেশে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের কারণে ২১৮টি শোকজ নোটিশ দিয়েছে।
প্রার্থীর পাশাপাশি তাদের অনুসারী নেতাকর্মী-সমর্থক এবং কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। কারও কারও বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগও রয়েছে।
আচরণবিধি ভঙ্গেও এগিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও তাদের সমর্থকেরা। যে ২১৮টি শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ৯২ জন—তাদের ৫৩ জনই আবার বর্তমান সংসদ সদস্য। পাশাপাশি ২৮ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জাতীয় পার্টির ৯ জন প্রার্থীকেও শোকজ করা হয়েছে।
এছাড়া শোকজ নোটিশ পাওয়া বাকিদের মধ্যে আছেন দলের কর্মী-সমর্থক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তবে এই দলেও ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থক বেশি
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দাবি, আচরণবিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে তারা কঠোর অবস্থানে আছে, কিন্তু ক্রমবর্ধমান সংঘাত ও সহিংসতা থামাতে তাদের কোনো দৃশ্যমান কঠোর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
আচরণবিধি ও নির্বাচনী আইন ভঙ্গে এখন পর্যন্ত ইসির পদক্ষেপ শোকজ দেওয়া, দোষী প্রার্থীকে সতর্ক করা এবং কিছু জায়গায় আচরণবিধি ভঙ্গে জরিমানা করার মধ্যেই আবদ্ধ। এর থেকে কঠোর শাস্তি ইসি নেয়নি, যদিও তারা কঠোর শাস্তির হুমকি দিয়ে আসছে।
নির্বাচনী সংঘাত ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে ইসি কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে জানিয়ে শনিবার নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেছেন, 'আজকেও আমরা কিছু কঠোর পদক্ষেপের বিষয়ে আলোচনা করেছি। আরও কিছু তথ্য চেয়েছি। আগামীকাল পেলে দেখবেন, কিছু কঠোর সিদ্ধান্তে চলে যাব।'
কোনো না কোনো জায়গায় প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যাবে—এমন আভাসও দেন তিনি।
তবে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর গতকাল বলেছেন যে প্রার্থিতা বাতিলের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। প্রত্যেক প্রার্থীর আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ সতর্কতার সঙ্গে মূল্যায়ন প্রয়োজনী বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন ইসির কাজের ধরনের সমালোচনা করে বলেছেন, ইসি বাস্তব পদক্ষেপ না নিয়ে শুধু বলার জন্যই এসব কথা বলছে।
তিনি জোর দিয়েছিলেন যে খালি হুমকি এবং ভয় দেখিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না, সহিংসতার জন্য দায়ী প্রার্থীদের অযোগ্য ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়ে যা প্রাণহানির ঘটনা ঘটায়।
তিনি বলেন, এরকম মুখে মুখে হুমকি-ধমকি দিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব নয়। অন্তত নির্বাচনী সহিংসতায় যেসব জায়গায় লোক মারা গেছে, ওইসব আসনের দায়ী প্রার্থীদের প্রার্থিতা বাতিল করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ইসির সাম্প্রতিক পদক্ষেপ
রোববার ঝিনাইদহ-১ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আব্দুল হাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছে ইসি।
এর আগে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ১৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের চার প্রার্থীকে সতর্ক করে ইসি। 'ভবিষ্যতে আচরণবিধি প্রতিপালন করার শর্তে' তাদের সতর্ক করা হয়।
আর মাঠে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরাও কিছু ক্ষেত্রে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় জরিমানা করেছেন।
ঝিনাইদহের শৈলকূপা ও হরিণাকুন্ডু উপজেলায় নির্বাচনী প্রচারণায় সংঘর্ষের সময় গাফিলতির অভিযোগে পুলিশ প্রধানদের প্রত্যাহার ইসির একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ নিশ্চিত করেছেন যে পুলিশের পক্ষ থেকে 'অবহেলার' প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এ পর্যন্ত নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত ৪
নির্বাচনী সহিংসতায় এ পর্যন্ত চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের লালানগর গ্রামে বিএনপি নেতা নুরুল মোস্তফাকে (৫০) গুলি করে হত্যা করা হয়। পুলিশ এ হত্যাকাণ্ডের জন্য জমি-সংক্রান্ত বিরোধকে দায়ী করলেও বিএনপি একে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বলছে।
শনিবার মাদারীপুরে কালকিনি উপজেলায় হামলায় আহত একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী এসকানদার খাঁ (৫০) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এসকানদারকে হাতুড়ি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাথাড়ি পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করা হয়।
এর আগে গত ১৯ নভেম্বর ময়মনসিংহ-৪ আসনে অস্থায়ী নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপন নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ কর্মী রফিকুল ইসলামের মৃত্যু হয়। একই ভাবে গত ৯ ডিসেম্বর পিরোজপুর সদর উপজেলার বটতলা এলাকায় নৌকার সমর্থকদের হামলায় আহত লালন ফকির নামের এক যুবক চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১১ ডিসেম্বর মারা যান।
সংঘর্ষে আহত দেড়শতাধিক
প্রায় ৪০টি আসনে সংঘটিত সংঘর্ষে দেড়শতাধিক আহত হয়েছে বলে উঠে এসেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম-১৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকের বাড়ি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই বৃহস্পতিবার রাতে সাতকানিয়ার কাটাখালী ব্রিজ এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দীন চৌধুরী নদভীর পক্ষে চালানো গণসংযোগে হামলা হয়েছে। এতে নদভীর শ্যালকসহ ১৫ জন আহত হয়েছেন।
এর আগে বুধবার রাতে সাতকানিয়ার ইছামতী আলীনগর এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল মোতালেবের এক সমর্থকের বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়।
রাজশাহীর চারঘাটে গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজশাহী-৬ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী রাহেনুল হকের এক কর্মীকে নৌকা প্রতীকের নির্বাচনী অফিসে নিয়ে কুপিয়ে জখম করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আহত নাজির হোসেন (৩৯) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন আছেন। এ ঘটনায় চারঘাট থানায় দায়ের মামলায় দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
শুক্রবার রাতে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে নৌকার প্রার্থী সেলিম আলতাফ জর্জের সমর্থকদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রউফের (ট্রাক) সমর্থকদের সংঘর্ষে ছয়জন আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় পুলিশ কয়েকজনকে আটক করেছে।
মেহেরপুরের গাংনীর হেমায়েতপুর গ্রামে শনিবার ভোরে মেহেরপুর-২ আসনে নৌকার প্রার্থী এ এস এম নাজমুল হক সাগরের নির্বাচনী অফিসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এছাড়া রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা ইউনিয়নের ১ নম্বর দিঘা ওয়ার্ডে রাজশাহী-৬ আসনের নৌকার নির্বাচনী কার্যালয়েও ভোরে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকা-১৯ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদের কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগে শনিবার ভোরে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
যশোরের ঝিকরগাছা-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নৌকার প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় অন্তত ছয়জন আহত হয়েছেন।
এছাড়া বগুড়া-৪ আসনে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে নৌকার সমর্থকদের হাতে হামলার শিকার হয়েছেন বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম। এ সময় হামলাকারীরা হিরো আলমের মোবাইল কেড়ে নেয় বলে অভিযোগ করেছেন হিরো আলম। শনিবার সন্ধ্যায় নন্দীগ্রামের মুরাদপুর বাজার এলাকায় এই হামলার ঘটনা ঘটে।