অভাবে স্কুলছাড়া, এখন সংগঠক-উদ্যোক্তা; রংপুরে জাপাকে হঠাতে চান হিজড়া প্রার্থী রানী
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুইজন হিজড়া প্রার্থী হয়েছেন; তাদের একজন রংপুরের আনোয়ারা ইসলাম রানী।
রংপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র এ প্রার্থীর প্রতীক 'ঈগল'। জীবনের প্রথম এ নির্বাচনে তার প্রতিপক্ষও বড় — জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
গত ৩২ বছরে এ আসনে জাপা কেবল একবারই হেরেছে। কিন্তু রানী জেতার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী; কারণ 'জাপা নেতারা জেতার পর কখনো তাদের কথা রাখেন না, এ নিয়ে বিরক্ত রংপুর-৩-এর ভোটারেরা'।
'রংপুরের মানুষ এখন আর জাতীয় পার্টিকে চাচ্ছে না। বর্তমানে এলাকায় এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যেখানে আমি জনাব জি এম কাদের সাহেবকে আমার নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বীও মনে করছি না। যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, যদি আমার সঙ্গে কোনো অন্যায় না হয়; তাহলে জি এম কাদের আমার কাছে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হবেন,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।
সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবনের এ পর্যায়ে এসেছেন রানী। রংপুরের সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী রানী অভাবের কারণে এক পর্যায়ে লেখাপড়ার পাট চোকাতে বাধ্য হন।
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নূরপুর এলাকার ২৬ নং ওয়ার্ডে একটি নিম্ন আয়ের পরিবারে তার জন্ম। বাবা ছিলেন একজন পরিবহনকর্মী। ২০১১ সালে মারা যান তিনি। রানীর বড়ভাই এলাকার একজন ঠিকাদারের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন।
নির্বাচনী হলফনামায় আনোয়ারা ইসলাম রানীর ব্যবসা ছাড়া আর কোনো খাতে আয়ের উল্লেখ নেই। ব্যবসা করে তিনি বছরে চার লাখ ৮০ হাজার টাকা আয় করেন।
হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, তার কাছে নগদ টাকা আছে ৫৫ হাজার। নির্ভরশীলদের আছে এক লাখ ২২ হাজার টাকা। ব্যাংকে রানীর নামে জমা ২৩ লাখ ৬৪ হাজার ৮৭০ টাকা। এছাড়া তার সাড়ে ৩৬ লাখ টাকা মূল্যের একটি টয়োটা গাড়ি রয়েছে।
স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে রানীর অকৃষি জমি রয়েছে ছয় শতক, যার মূল্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা। আর ভূমিহীন হিসেবে পাওয়া দুই শতক জমির কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন তিনি; যার দাম আট লাখ টাকা বলেছেন। নির্বাচনের জন্য ভাই ও ফুফু তাকে দান হিসেবে এক লাখ টাকা দেবেন বলে জানিয়েছেন।
রাজনীতিতে একদম নতুন মুখ আনোয়ারা ইসলাম রানী। তিনি বলেন, 'আমি আগে কখনো কোনো রাজনীতি করিনি। আমি সংগঠক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা।'
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ২০০৯ সালে 'ন্যায় অধিকার' নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন রানী। এই সংগঠনের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। 'এটির মাধ্যমে তৃতীয় লিঙ্গের ৪১ জনের জীবিকার ব্যবস্থা করেছি। এরপর 'রূপান্তর' নামক আরেকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেছি। সেখানেও আমাদের কমিউনিটির পিছিয়ে পড়া ২৪ জন লোক কাজ করছেন,' বলেন তিনি।
হঠাৎ ভোটের মাঠে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে রানী বলেন, 'রংপুরের মানুষ সহজ-সরল। এ কারণে বছরের পর বছর ধরে জাতীয় পার্টির নেতাদের ভালোবেসে তারা ভোট দিয়েছেন। আমাদের ভোট নিয়ে উনারা নির্বাচিত হওয়ার পর ঢাকামুখী হয়ে যান। বার বার একই কাজ করেছেন তারা। রংপুরের মানুষের জন্য উনারা কিছুই করেননি। এ কারণে মানুষের সেবার জন্য আমি এসেছি।'
রংপুরের মানুষ আর জাতীয় পার্টি চাচ্ছে না মন্তব্য করে রানী বলেন, 'রংপুরের মানুষ দলটিকে বয়কট করেছে। বিশেষ করে জি এম কাদেরকে একেবারেই চাচ্ছে না। এটা আমার কথা নয়। এ কথা রংপুরের আপামর জনতার। শতকরা ৯০ ভাগ লোক জি এম কাদেরকে চায় না।'
রানী জানান, তিনি মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন। 'এ এলাকার মানুষ আমাকে সাদরে গ্রহণ করছেন। জাতীয় পার্টির মানুষ আমার জন্য টাকা খরচ করে পোস্টার করছেন। যেখানে যাচ্ছি শতশত মানুষ আমাকে বলছেন, তারা আর লাঙল চান না। বর্তমানে রংপুর জাতীয় পার্টির ঘাঁটি আর নেই। আর কেউ তাদের চাচ্ছে না। এখন এ পরিবেশে আমি জনাব জি এম কাদের সাহেবকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বীও মনে করছি না,' বলেন তিনি।
এমপি হলে উন্নয়ন পরিকল্পনায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেবেন জানতে জাইলে আনোয়ারা রানী বলেন, 'রংপুরে আমার জনগোষ্ঠীর মানুষ ১০০ থেকে ১২০ জন। তাদের মধ্যে ৬৪ জনের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আমি এমপি হলে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার ব্যবস্থা করব। সেখানে তাদের চাকরির ব্যবস্থা হবে। কর্মমুখী হবে সবাই। কারও আর ভিক্ষা করতে হবে না।
'যেখানে যুগের পরিবর্তন হয়েছে, দেশের পরিবর্তন হয়েছে, মানুষের পরিবর্তন হয়েছে — এ কারণে আমি শুরু থেকেই চাচ্ছি আমাদের সকলের পরিবর্তন হোক। সকলে কর্মমুখী হলে সমাজে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। তখন কেউ আমাদের নিয়ে আর হাসাহাসি করতে পারবে না।'
রংপুর ভোটের মাঠে ব্যাপক সাড়া জাগানো এ প্রার্থী আরও বলেন, 'তৃতীয় লিঙ্গ বলেন কিংবা হিজড়া বলেন; এখন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। রংপুরের মানুষ বুঝে গেছে আমার কোনো পিছুটান নেই, স্বামী-সংসার নেই। সুতরাং আমার বাড়ি-গাড়ি কিংবা সম্পদের কোনো প্রয়োজন নেই।'
আসন্ন ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে রংপুর-৩ আসনে সাতজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। জি এম কাদের ছাড়াও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, বাংলাদেশ কংগ্রেস, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এবং ন্যাশনাল পিপলস পার্টির প্রার্থীদের বিরুদ্ধেও লড়তে হবে রানীকে।
তবে তিনি ভয় পাচ্ছেন না। 'আমাকে রংপুরের মানুষ সাদরে গ্রহণ করেছেন। ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। এখন আর কেউ লিঙ্গ-পরিচয় দেখছে না। আমার মধ্যে নতুন আলোর সম্ভাবনা দেখছেন রংপুরবাসী।'