পরিবেশ, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে লেমিনেটেড পোস্টারে সয়লাব করে ফেলা হয়েছে রাজধানী
নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্লাস্টিকের লেমিনেটেড পোস্টারে সয়লাব করে ফেলা হয়েছে ঢাকা শহরের সড়কগুলো। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের জন্য ভোট চেয়ে ঝোলানো হয়েছে এসব পোস্টার। প্লাস্টিকের লেমিনেটেড পোস্টার ঝোলানোর তালিকায় ক্ষমতাসীন দলের বেশ কিছু বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদও আছেন।
২০২০ সালের ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তুলনায় এবার লেমিনেটেড পোস্টারের সংখ্যা ৫০ শতাংশ বেড়েছে বলে ধারণা করছেন পরিবেশবিদ ও গবেষকরা।
ঢাকা-৯ আসনের আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সাবের হোসেন চৌধুরীর লেমিনেটেড পোস্টার বর্তমানে তার নির্বাচনী এলাকা মালিবাগ, খিলগাঁও, গোরান, বাসাবো ও সবুজবাগ এলাকাজুড়ে টাঙানো রয়েছে।
শুধু প্রধান সড়কের পাশেই নয়, ছোট ছোট গলিতেও ঝুলতে দেখা গেছে তার পোস্টার।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাবের হোসেন একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষ দূত এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের নির্বাচনের সময় পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর লেমিনেটেড পোস্টার ব্যবহার বন্ধের ব্যাপারে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। আদালতের ওই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশের প্রতি সাবের হোসেনের প্রচারণা দলের এই অবহেলার তীব্র সমালোচনা করেছে সুশীল সমাজ ও পরিবেশবাদীরা।
এছাড়া ভোটের প্রচারে যত্রতত্র পোস্টার, ব্যানার, লিফলেটসহ নানা ধরনের প্রচার সামগ্রীতে প্লাস্টিকজাত বা পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে ব্যবস্থা নিতে বিশেষ পরিপত্র জারি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
রিটার্নিং অফিসারদের কাছে এ-সংক্রান্ত 'বিশেষ পরিপত্র' দিয়ে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের আচরণবিধির বিষয়ে সতর্ক করতে নির্বাচনি এলাকায় নিয়োজিত ভিজিল্যান্স, অবজারভেশন ও মনিটরিং টিম এবং আইনশৃঙ্খলা সেলের সদস্যদের নিয়ে নির্বাহী ও বিচারিক হাকিমদের যথাযথ নির্দেশনা দিতে বলেছে ইসি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। তবে তিনি কোনো কল ও মেসেজেরই উত্তর দেননি।
রিটার্নিং অফিসার ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, ঢাকার বিভিন্ন আসনে যে প্লাস্টিকের লেমনেটেড পোস্টারের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো হচ্ছে, সেটি তিনি জানেন না।
তিনি 'নির্বাচন কমিশনের বিধির বাইরে গিয়ে পোস্টারিংয়ে প্লাস্টিক ব্যবহার করার বিষয়টি আমাদের নজরে এলে আমরা ব্যবস্থা নেব। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরাও নিজ নিজ এলাকায় কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ পেলে প্রার্থীদের সতর্ক করাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছেন।'
তিনি আরও বলেন, এখন কুয়াশা থাকায় কেউ কেউ হয়তো পোস্টার লেমনেট করতে পারেন; তবে এমন বিষয় নজরে পড়লে তারা ব্যবস্থা নেবেন।
পরিবেশকর্মী স্থপতি ইকবাল হাবিব টিবিএসকে বলেন, যারা পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
'এ প্লাস্টিক আমাদের জলাধার, নদী, খাল, পরিবেশের জন্য হুমকি। আর নির্বাচনে এর ব্যবহারকারীদের অবশ্যই জনগুণের প্রত্যাখ্যান করা উচিত,' বলেন তিনি।
অন্য প্রার্থীরাও করছেন এ কাজ
শুধু সাবের হোসেন চৌধুরীই নন, রাজধানীতে বিভিন্ন আসনের অন্তত ২০ জন প্রার্থী তাদের নির্বাচনী এলাকায় প্লাস্টিক লেমনেটিং করা পোস্টার দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। তাদের মধ্যে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা আওয়ামী লীগের প্রার্থীই বেশি।
এদের মধ্যে ঢাকা ৮ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী বাহাউদ্দিন নাছিমের প্রচারণার পোস্টার লেমনেটিং করে ঝোলানো হয়েছে ইস্কাটন, রমনা, শাহাবাগ এলাকায়।
ঢাকা-১০ আসনের নৌকার প্রার্থী চিত্রনায়ক ফেরদৌস ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, হাজারীবাগ এলাকায় প্লাস্টিক লেমনেটিং করা পোস্টার ঝুলিয়েছেন।
এছাড়া গুলশান এলাকায় ঢাকা-১৭ আসনের বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির প্রার্থী শাহ আলম এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী আরাফাত আশওয়াদ ইসলামের প্রচারণায় প্লাস্টিকের লেমনেটেড পোস্টার ঝোলানো হয়েছে।
ঢাকা-৬ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থ সাঈদ খোকন, ঢাকা-৪ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী আবু হোসেন বাবলা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সানজিদা খানম, ঢাকা-৭ আসনের প্রার্থী মোহাম্মাদ সোলায়মান সেলিমও তাদের নির্বাচনী এলাকায় প্লাস্টিক-লেমিনেটেড পোস্টারের মাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
পরিবেশগত ক্ষতি
২০২০ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-এর (এসডো) করা একটি গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরে প্রতি বছর বিভিন্ন উৎস থেকে গড়ে প্রায় ১০ হাজার টনের ওপর লেমিনেটেড প্লাস্টিকের বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যা মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।
এ গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২০ সালে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের প্রচারণা শুরুর ১২ দিনের মধ্যেই ২ হাজার ৪৭২ টন লেমিনেটেড প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়।
২০২০ সালের সিটি নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে আদালতে রিট করে এসডো। এর পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় প্লাস্টিকের ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত।
এসডোর সেক্রেটারি জেনারেল ড. শাহরিয়ার হোসেন টিবিএসকে বলেন, '২০২০ সালে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যে পরিমাণ লেমনেটিং পোস্টার ছাপানো হয়েছিল এবারের জাতীয় নির্বাচনে ঢাকায় তারচেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি ছাপানো হয়েছে বলে আমাদের প্রাথমিক গবেষণায় উঠে এসেছে। সামনে আরও কয়েকদিন বাকি আছে, এর মধ্যে হয়তো এর পরিমাণ আরও বাড়বে।'
তিনি আরও বলেন, আমরা এবারেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর চিঠি দিয়েছি লেমনেটেড পোস্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। এরপরেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।