জাপাকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন স্বতন্ত্রদের দখলে
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অর্ধশতাধিক আসনে বিজয়ী হয়ে জাতীয় পার্টিকে (জাপা) রীতিমতো ধরাশায়ী করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। সোমবার রাত ১টা পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুসারে, এবারের নির্বাচনে জাপা মাত্র ১১টি আসনে জিতেছে, বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৫৮টি আসনে।
আগামী সংসদে এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে বিরোধী দলের অবস্থানও হারাতে হতে পারে জাপাকে।
কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী মন্ত্রীসহ হেভিওয়েটদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছেন।
বিএনপির বর্জনের মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ার কৌশল ভোটার উপস্থিতি কিছুটা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এজন্য বড় মাশুল দিতে হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন পাওয়া জাপা প্রার্থীদের।
নির্বাচনের আগে সমঝোতার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ তাদের মিত্র জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল। বর্তমান সংসদে জাপার আসনসংখ্যা ২৭টি।
কিন্তু এবারের নির্বাচনে দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরীফা কাদের ও তার ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার এবং শামীম হায়দার পাটোয়ারীসহ জাপার বেশ কয়েকজন বড় প্রার্থী যথাক্রমে আহমেদ খসরু চৌধুরী, আসাদুজ্জামান এবং আবদুল্লাহ নিগারের মতো স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে হেরে গেছেন।
অন্যান্য হেভিওয়েট প্রার্থীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে কুষ্টিয়া-২ আসনে হারিয়ে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী কামারুল আরেফিন।
হবিগঞ্জ-৪ আসনে নৌকার প্রার্থী বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীকে হারিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যরিস্টার সায়েদুল হক সুমন। এছাড়া মানিকগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং তিনবারের সংসদ সদস্য জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী মমতাজ বেগমকে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু।
স্বতন্ত্র প্রার্থী সবচেয়ে বেশি জিতেছেন কুমিল্লা ও টাঙ্গাইলে। এ দুটি জেলার সাতটি আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের হারিয়ে জয়লাভ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
এর মধ্যে কুমিল্লা-২ আসনে অধ্যক্ষ আবদুল মজিদ, কুমিল্লা-৩ আসনে জাহাঙ্গীর আলম সরকার, কুমিল্লা-৪ আসনে আবুল কালাম আজাদ এবং কুমিল্লা-৫ আসনে এম এ জাহের—এই পাঁচ স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেছেন।
টাঙ্গাইলে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আসনে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। টাঙ্গাইল-৪ আসনে নৌকার প্রার্থী মাজহারুল আনোয়ার ঠান্ডুকে হারিয়ে জয়লাভ করেছেন আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। এছাড়া টাঙ্গাইল-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আমানুর রহমান খান রানা এবং টাঙ্গাইল-৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. ছানোয়ার হোসেন জয়লাভ করেছেন।
এছাড়া অন্যান্য স্বতন্ত্র বিজয়ীদের মধ্যে আছেন ঝিনাইদহ-২ আসনে রেডিয়েন্ট ফার্মার চেয়ারম্যান নাসের শাহরিয়ার জাহিদী, নেত্রকোনা-৩ আসনে ইফতেখার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু, ফরিদপুর-৩ আসনে হা-মীম গ্রুপের এমডি একে আজাদ, নওগাঁ-৬ আসনে অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক সুমন ও দিনাজপুর-১ আসনে জাকারিয়া জাকা।
আরও বেশ কিছু আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। জামালপুর-৪ আসনে জয়লাভ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রিন্সিপাল আব্দুর রশিদ, নরসিংদী-৩ আসনে সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, নীলফামারি-৩ আসনে সাদ্দাম হোসেন পাভেল, নীলফামারি-৪ আসনে সিদ্দিকুল আলম, লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে আব্দুল্লাহ আল মামুন, ময়মনসিংহ-৫ আসনে নজরুল ইসলাম ও মাদারীপুর-৩ আসনে তাহমিনা বেগম জয়ী হয়েছেন।
গত দুইবারের মতো এবারও ফরিদপুর-৪ আসনে জয়ী হয়েছেন মুজিবুর রহমান (নিক্সন) চৌধুরী। ঢাকা-১৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী খসরু চৌধুরী, নওগাঁ-৪ আসনে এসএম সুলতান মামুদ, নাটোর-১ আসনে আবুল কালাম, কিশোরগঞ্জ-২ আসনে অ্যাডভোকেট সোহরাব উদ্দিন ও কুড়িগ্রাম-২ আসনে হামিদুল হক খন্দকার জয়লাভ করেছেন।
চট্টগ্রাম-১৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের প্রার্থিতা ভোটগ্রহণের শেষ সময়ে বাতিল হওয়ার পর ওই আসনের ফলাফলে স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবুর রহমান জয়ী হয়েছেন। এছাড়া চট্টগ্রাম-১৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল মোতালেব ও রংপুর-৫ আসনে জাকির হোসেন সরকার জয়ী হয়েছেন।
এছাড়া রাত পর্যন্ত ঢাকা-১৯ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনিত প্রার্থী প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর চেয়ে ভোটে বেশ পিছিয়ে ছিলেন।
ভোটার আনতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কৌশলে সুফল পেয়েছে আওয়ামী লীগ
বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতিতে ভোটার বৃদ্ধির লক্ষ্যে গতকালের সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতাদের মাঠে নামানোর কৌশল ফল দিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, গতকাল বিকাল ৩টা পর্যন্ত সারা দেশে ভোট পড়েছিল মাত্র ২৬.৩৭ শতাংশ। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা লড়ছেন, এমন ২৬টি আসনের ভোটের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুপুর ২টা পর্যন্ত ওই সব আসনে ভোট পড়েছে গড়ে ৩৪ শতাংশের বেশি।
নির্বাচন কমিশনের স্মার্ট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ অনুসারে, বেশ কয়েকটি আসনে দুপুর ২টার মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে। অন্তত একটি কেন্দ্রে ৫৩ শতাংশ ভোট দেওয়ার হার রেকর্ড করা হয়েছে।
ভোটগ্রহণ শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের কাছে প্রাথমিক ভোটের হিসাব তুলে ধরেন। তিনি প্রথমে বলেছিলেন, ভোট পড়েছে ২৮ শতাংশ। পরে নির্বাচন কমিশন সচিব মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম সিইসির কথা সংশোধন করে দেন। তখন সিইসি বলেন, ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে।
ইসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৮০.২ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৪০ শতাংশ এবং ২০০৮ সালে ৮৭ শতাংশ ভোট পড়েছিল।