নির্বাচনের মাঠে তারকাদের কে জিতলেন কে হারলেন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে যে নামটি ছিল, তা হলো 'সাকিব আল হাসান'। ক্রিকেটার হয়ে জনপ্রতিনিধি হতে যাওয়ার তার এ সিদ্ধান্ত নিয়ে চায়ের কাপে তর্কের ঝড় উঠেছে পাড়া-মহল্লায়। সাকিবের মতো জনপ্রিয় তারকাদের জনপ্রতিনিধি হওয়ার ঘটনা এবারের নির্বাচনেই প্রথম নয়।
বিগত জাতীয় নির্বাচনগুলোতেও তারকাদের এমপি হওয়ার দৌড়ে নামতে দেখে গেছে। তবে আগে অনেক তারকাদের শুধু নির্বাচনী প্রচারণায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেখা গেলেও এবার তাদের মধ্যে দেখা গেছে মনোনয়নপত্র কেনার হিড়িক। আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা অনেকে স্বতন্ত্র হয়েও নির্বাচন লড়েছেন। মনোনয়ন না পেয়ে অনেকে আশাহতও হয়েছেন। শোবিজ অঙ্গনে সফল হলেও ভোটের মাঠে অনেকেই হয়েছেন ব্যর্থ। তারকাদের নির্বাচনের সার্বিক চিত্র দেখা যাক এক নজরে।
মনোনয়ন চেয়েও পাননি যারা
আওয়ামী লীগ থেকে এবার বিনোদন জগতের যেসব তারকা মনোনয়ন পেয়েছিলেন তারা হলেন, অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর (নীলফামারী-২), চিত্রনায়ক ফেরেদৗস আহমেদ (ঢাকা-১০) ও কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম (মানিকগঞ্জ-২)। খেলোয়াড়দের মধ্যে মনোনয়ন পেয়েছিলেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান (মাগুরা-১) ও মাশরাফি বিন মর্তুজা (নড়াইল-২)।
তবে অনেক তারকাই আছেন যারা মনোনয়ন কিনলেও পাননি নৌকার টিকিট। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি। নৌকা প্রতীক না পেয়ে স্বতন্ত্র ট্রাক প্রতীকে লড়েছেন রাজশাহী-১ আসনে।
ছোটপর্দার অভিনেতা সিদ্দিকুর রহমান ঢাকা-১৭ এবং টাঙ্গাইল-১ আসনের ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। নৌকা প্রতীক পাননি তিনিও।
বরিশাল-৩ আসনের মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন চিত্রনায়ক রুবেল। গত নির্বাচনেও 'বাগেরহাট-৩' আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন চিত্রনায়ক শাকিল খান। তারা মনোনয়ন পাননি এবারও।
ঢাকা-৮ আসনে আওয়ামী লীগের হয়ে লড়ার জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী, অভিনেতা ও পরিচালক এসডি রুবেল। আর চিত্রনায়িকা সামসুন্নাহার সিমলা সংগ্রহ করেছিলেন ঝিনাইদহ-১ আসন থেকে। তবে দুজনের কেউই নৌকার হয়ে এবার নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি।
তবে এদের মধ্যে আসাদুজ্জামান নূর, মাশরাফি বিন মর্তুজা ও মমতাজ বেগম একাদশ সংসদ নির্বাচনেও নৌকার হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
পঞ্চমবারেও বাজিমাত আসাদুজ্জামান নূরের
নীলফামারী-২ আসন থেকে আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন 'বাকের ভাই'খ্যাত এই জনপ্রিয় অভিনেতা। ২০০১ সাল থেকে তিনি আওয়ামী লীগের হয়ে এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এ নিয়ে টানা পঞ্চমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন তিনি। এছাড়া বিগত মন্ত্রিসভায় সংস্কৃতিমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে নীলফামারী-২ আসনের ১৩৫টি ভোটকেন্দ্রের বিপরীতে আসাদুজ্জামান নূর পেয়েছেন ১ লাখ ১৯ হাজার ৩৩৯ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়নাল আবেদীন পেয়েছেন মাত্র ১৫ হাজার ৬৮৪ ভোট। মোট ভোটার ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯১ জন। মোট ভোটারের মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৭৯ হাজার ৭১৮ ও নারী ভোটার ১ লাখ ৭৯ হাজার ৭৩ জন।
সাকিবের নতুন ইনিংস
ক্রিকেটের পর রাজনীতির মাঠে নতুন ইনিংসের সূচনা করেছেন সাকিব আল হাসান। প্রথমবারেই করলেন বাজিমাত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাগুরা-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ও বিশ্বখ্যাত এ অলরাউন্ডার।
রোববার (৭ জানুয়ারি) বিকাল ৪টায় সমাপ্ত হওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩৮৮ ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেন সাকিব।
তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ডাব মার্কার প্রার্থী অ্যাডভোকেট কাজী রেজাউল হাসান পেয়েছেন ৪৫ হাজার ৯৩৩ ভোট।
সাইফুজ্জামান শিখর মাগুরা-১ আসনের আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য হলেও এবার দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে নির্বাচনে সাকিবকে সমর্থন দেন তিনি।
টানা দুইবার মাশরাফির বাজিমাত
নড়াইল-২ (লোহাগড়া উপজেলা ও সদরের একাংশ) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাশরাফি বিন মোর্তজা ১ লাখ ৮৫ হাজার ৬১ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন।
জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি নৌকা প্রতীকে ভোট পেয়েছেন ১ লাখ ৮৯ হাজার ১০২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির শেখ হাফিজুর রহমান হাতুড়ি প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৪ হাজার ৪১ ভোট।
হ্যাট্রিকের পর থামতে হলো মমতাজকে
মানিকগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও তিনবারের সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলুর কাছে হেরেছেন। চতুর্থবার এসে সংসদ সদস্যের পদ হারালেন তিনি।
রোববার রাতে রিটার্নিং অফিসার ঘোষিত প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী, 'ট্রাক' প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে টুলু ১৯৩টি ভোটকেন্দ্রে ৮৪ হাজার ৫২৫ ভোট পেয়েছেন।
অন্যদিকে নৌকা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মমতাজ পেয়েছেন ৭৮ হাজার ২৬৯ ভোট।
স্বতন্ত্র মাহিয়া মাহির পরাজয়
রাজশাহী-১ আসন থেকে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। তবে ভোটে পরাজিত হয়েছেন তিনি।
শুরুতে আওয়ামী লীগের হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন মাহি। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষিত মনোনয়ন তালিকায় নাম না থাকায় পরে রাজশাহী–১ আসনে মাহি স্বতন্ত্র থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন।
এই আসনে ভোটারসংখ্যা ৪ লাখ ৪০ হাজার ২১৮ জন। ১৫৮টি কেন্দ্রের ফলাফল গণনা শেষে দেখা গেছে, মাহিয়া মাহি এই আসন থেকে মোট ভোটের মধ্যে মাত্র ৯,০০৯ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন।
তবে নির্বাচনের দিন সাংবাদিকদের মাহি বলেন, 'ফলাফল যা হওয়ার হবে। আমি হারি আর জিতি, ইনশাআল্লাহ কালকে (সোমবার) পুরো এলাকায় একটা শোডাউন দেব। হেরে গেলেও সবাইকে জানান দেব, আমি তাদের সঙ্গে আছি।'
এই আসন থেকে বিজয়ী প্রার্থী আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী ওমর ফারুক চৌধুরী পেয়েছেন সর্বোচ্চ ১ লাখ ৩ হাজার ৫৯২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কাঁচি প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম রাব্বানী পেয়েছেন ৯২ হাজার ৪১৯ ভোট।
নৌকার মাঝি ফেরদৌস
১৯৯৭ সালে 'বুকের ভেতর আগুন' ছবি দিয়ে চলচ্চিত্রে পা রাখা এ অভিনেতা এবার নাম লিখিয়েছেন রাজনীতির খাতায়। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশে জনপ্রিয় অভিনেতা ফেরদৌস এবার ঢাকা-১০ আসন থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন।
সাম্প্রতিক কয়েক বছর ধরে অভিনয়ের পাশাপাশি রাজনীতিতেও বেশ সক্রিয় দেখা যাচ্ছিল ফেরদৌসকে। বিগত বছরগুলোতে তাকে দেখা গেছে নৌকার হয়ে সারাদেশের আনাচেকানাচে প্রচারণা চালাতে। তাই ধারণা করা হচ্ছিল সংসদ সদস্য হওয়ার দৌড়েই আছেন তিনি। অবশেষে সফলও হয়েছেন, এবারই আওয়ামী লীগের হয়ে প্রথম নির্বাচন লড়েছেন এবং করেছেন বাজিমাত।
আওয়ামী লীগের হয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে ৬৫ হাজার ৮৯৮ ভোট পেয়েছেন তিনি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যাশনাল পিপলস পার্টির প্রার্থী শামসুল আলম আম প্রতীকে পেয়েছেন ২ হাজার ২৫৭ ভোট।
নির্বাচন বর্জন ডলি সায়ন্তনীর
জনপ্রিয় গায়িকা ডলি সায়ন্তনী পাবনা-২ আসনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তবে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ভোট বর্জন করেছেন এই জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী।
রোববার (৭ জানুয়ারি) দুপুর আড়াইটার দিকে সুজানগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় প্রাঙ্গণে গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতিতে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন তিনি।
তবে ফলাফলে দেখা যায়, মাত্র ৪ হাজার ৩৮২ ভোট পেয়েছেন তিনি। এই আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের বিজয়ী প্রার্থী ফিরোজ কবির পেয়েছেন ১ লাখ ৬৫ হজার ৮৪২ ভোট।