পর্যাপ্ত চামড়ার জোগান থাকার পরও বাংলাদেশ কেন চামড়া আমদানি বন্ধ করতে পারছে না
দেশীয় কাঁচা চামড়ার পর্যাপ্ত জোগান থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিমুখী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প কারখানাগুলোকে বছরে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার (প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার) লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সনদপ্রাপ্ত ফিনিশড চামড়া আমদানি করতে হয়। এর ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর পড়ছে, যা ২০২১ সালের ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে দাঁড়িয়েছে।
শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই চ্যালেঞ্জের মূল কারণ দেশের ট্যানারিগুলো। স্থানীয় ট্যানারিগুলো বর্তমান বৈশ্বিক মানদণ্ড পূরণ করতে পারছে না বলে উল্লেখ করেন তারা। মূলত সাভার চামড়াশিল্প নগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) না থাকার কারণেই স্থানীয় ট্যানারিগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করতে পারছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অভ লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির পরিচালক ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বৈশ্বিক চামড়াশিল্পের কাঁচামালের যে চাহিদা, তার প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। তবে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বৈশ্বিক মোট রপ্তানির মাত্র ০.৭ শতাংশ।
'অর্থাৎ কাঁচামালের সহজলভ্যতা থাকলেও সেটা আমরা ব্যবহার করতে পারছি না, কারণ এলডব্লিউজি সনদ নেই। ফলে রপ্তানি বাড়াতে এই সনদ অর্জন করার কোনো বিকল্প নেই। চামড়া শিল্পের রপ্তানি বাড়াতে কারখানাগুলো বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী কমপ্লায়েন্ট হতে হবে।'
বাংলাদেশ শ্যু সিটি লিমিটেডের প্রকল্প পরিচালক সঞ্জয় সাহা টিবিএসকে বলেন, 'বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছ থেকে চামড়াজাত পণ্যের অর্ডার নিলে তারা শর্ত দেয় এলডব্লিউজি সনদ থাকা প্রতিষ্ঠানের চামড়া দিয়ে পণ্য বানাতে হবে।
'আমাদের প্রতিষ্ঠান ফাইভ-আর ফুটওয়্যার লিমিটেডে রপ্তানিযোগ্য পণ্য তৈরিতে ফিনিশড চামড়া আমদানি করতে হয়। দেশের মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের এলডব্লিউজি সার্টিফিকেশন আছে। অনেকসময় তাদের কাছে ফিনিশড চামড়া পাই না। তাই আমাদের এলডব্লিউজি সার্টিফাইড প্রতিষ্ঠান থেকে চামড়া আমদানি করতে হয়। প্রতি বছর ৫ থেকে ১০ লাখ বর্গফুট ফিনিশড চামড়া আমদানি করতে হয় আমাদের।'
স্থানীয় ট্যানারি কোম্পানিগুলোর পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র এবং এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় নিজেদের কাঁচামাল ব্যবহার না করে বিদেশি মুদ্রায় বিপুল ব্যয় করতে হয় বলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
বিডা বলছে, দেশীয় কোম্পানি এবং চামড়াশিল্প নগরীর তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) না থাকায় তাদের কাছ থেকে কাঁচামাল কিনছে না রপ্তানিকারকেরা। ফলে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা ব্যয়ের পাশাপাশি রপ্তানি সম্ভাবনাও কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চামড়া খাত থেকে দেশের রপ্তানি আয় এসেছিল ১ হাজার ২২৩.৬৩ মিলিয়ন ডলার।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, চামড়া ও পাদুকার মূল কাঁচামাল হচ্ছে কাঁচা চামড়া। বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে কাঁচা চামড়া থাকায় এ খাতে দেশের বিপুল রপ্তানি সম্ভাবনা রয়েছে।
'কিন্তু সিইটিপি না থাকায় আমরা এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারিনি। এই ব্যর্থতার সম্পূর্ণ দায়ভার বিসিকের (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন),' বলেন তিনি।
এলডব্লিউজির ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে মাত্র ৬টি প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত। সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার।
এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো এবিসি লেদার, রিফ লেদার, এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ, সাইমন ট্যানিং ইনকর্পোরেটেড (বাংলাদেশ) এবং সুপারএক্স লেদার লিমিটেড।
তাদের কারখানাগুলো বহুল আলোচিত সাভারের চামড়াশিল্প নগরের বাইরে অবস্থিত।
বিডার প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভারতে ১৩৯টি, চীনে ১০৩টি, ইতালিতে ৬৮টি, ব্রাজিলে ৬০টি, তাইওয়ানে ২৪টি, স্পেনে ১৭টি, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্কে ১৬টি এবং ভিয়েতনামে রয়েছে ১৪টি।
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং লেদার-গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ সব উন্নত দেশই স্বচ্ছ ও টেকসই সাপ্লাই চেইন চায়।
'এর জন্য উচ্চ স্তরের কমপ্লায়েন্স তথা সাপ্লাই চেইন সিকিউরিটি অডিট, ডিউ ডিলিজেন্স অডিট, কনজিউমার প্রডাক্ট সেফটি কমিশন (সিপিএসসি), নিরাপন ফায়ার সেফটি স্ট্যান্ডার্ড, লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ সার্টিফিকেশনের বাস্তবায়ন প্রয়োজন,' বলেন তিনি।
চামড়ার বৈশ্বিক বাজার
বৈশ্বিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফরচুন বিজনেস ইনসাইটসের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে চামড়াপণ্যের বৈশ্বিক বাজার ছিল প্রায় ৪৪০.৬৪ বিলিয়ন ডলারের। ২০৩০ সালে এ বাজারের আকার ৭৩৮.৬১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে।
সাভার সিইটিপিতে যেসব সমস্যা পেয়েছে বিডা
শিল্প মন্ত্রণালয় ২০০৩ সালে চামড়াশিল্প নগরী প্রকল্প হাতে নেয়। ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকার এই প্রকল্পের অধীনে সাভারের হেমায়েতপুরে ১৯৯ একর জমি অধিগ্রহণ করে ১৫৪টি ট্যানারিকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়।
পরিবেশ দূষণ রোধ করে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা ও রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত কমপ্লায়েন্ট চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিল সরকার।
এত টাকা খরচ করা হলেও পরিবেশ দূষণ বন্ধে কমন ক্রোম রিকভারি ইউনিট নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি। এছাড়া কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রিসোর্স জেনারেশনের ব্যবস্থা না থাকায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পাওয়া যায়নি। এর ফলে এলডব্লিউজি সনদও পাচ্ছে না এখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো।
কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার বা সিইটিপি এখনও পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। কঠিন বর্জ্য ফেলার জায়গা বা ডাম্পিং ইয়ার্ডের স্থায়ী ব্যবস্থাও হয়নি।
বিডার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, হাইকোর্টের নির্দেশনায় ২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলোকে বিসিকের আওতাধীন সাভারস্থ 'ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্ট্রেট'-এ স্থানান্তর করা হয়েছে। এ শিল্প নগরীতে বরাদ্দপ্রাপ্ত ১৬২টি ট্যানারির মধ্যে বর্তমানে ১৪০টি ট্যানারি উৎপাদনে রয়েছে, যারা ওয়েট ব্লু, ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়া উৎপাদন করে।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ শিল্পনগরী আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এলডব্লিউজি সনদ অর্জন করতে না পারার কারণে এখানকার ট্যানারিগুলো নিজেদের উৎপাদিত চামড়া ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানি বা নামী কোনো ব্র্যান্ডের কাছে বিক্রি করতে পারছে না, খুব কম মূল্যে—পশ্চিমা বাজারের চেয়ে প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ কম দামে—চীন বা অন্য দেশের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।
ট্যানারিতে এফ্লুয়েন্ট ডিসচার্জ নিয়ন্ত্রণে করণীয়
বিডার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এলডব্লিউজি সনদ পাওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে এফ্লুয়েন্ট ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম। নির্ধারিত এফ্লুয়েন্টের ডিসচার্জের সর্বোচ্চ সীমা অনুসারে প্রতিটি ট্যানারিতে পরিমিত পানির ব্যবহার করতে হবে ও উৎপাদন সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের জন্য চিলিং ব্যবস্থা: ঈদ-উল-আজহা-পরবর্তী পিক সময়ে প্রথম তিন মাসে সারা বছরের মোট ব্যবহারের প্রায় অর্ধেক কাঁচা চামড়া ট্যানিং হয় এবং অবশিষ্ট নয় মাসে অর্ধেক পরিমাণ চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হয়। ফলে পিক ও অফ পিক মৌসুমে এফ্লুয়েন্টের গড় পার্থক্য (দৈনিক ৩,৫০০–১৭,০০০ ঘনমিটার) বিশাল হয়ে যায়। এই পার্থক্যের জন্য সিইটিপির ডিজাইনের ওপর চাপ পড়ে এবং ট্রিটমেন্ট বাধাগ্রস্ত হয়।
এ সমস্যা সমাধানে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কাঁচা চামড়া সংক্ষণের জন্য চিলিং ব্যবস্থা করা হলে পিক সময় তিন মাসের পরিবর্তে পাঁচ মাস হতে পারে। এতে প্রক্রিয়াকরণের সময় বৃদ্ধি পাবে এবং পিক সময়ে সিইটিপিতে আসা এফ্লুয়েন্টের পরিমাণ কমে আসবে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান ও আঞ্জুমান ট্রেডিং করপোরেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহীন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী সাভার চামড়াশিল্প নগরীর দায়িত্ব তার সচিবকে দিয়েছেন। লক্ষ্য হচ্ছে, চামড়াশিল্প নগরীর সর্বোচ্চ সদ্বব্যবহারের উপায় খুঁজে বের করা এবং এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্তির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা।
'আমরা সনদ পাওয়ার জন্য কাজ শুরু করেছি। এর মধ্যে রয়েছে কারখানার কাজের পরিবেশ উন্নত করা, পানির ব্যবহার কম করা এবং জ্বালানি-সাশ্রয়ী ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা। আমরা এসব ক্ষেত্রের আরও উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে কাজ করছি,' বলেন তিনি।