বাড়ছে বাল্যবিবাহ ও বিচ্ছেদ, শঙ্কায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ
দেশে বাল্যবিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদের হার দুটোই বাড়ছে, যার দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের সামাজিক কাঠামো এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি।
১৫ ও ১৮ বছরের আগে বিয়ের হার ধারাবাহিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বাল্যবিবাহ নিয়ে উদ্বেগ রয়েই গেছে। ১৫ বছরের আগে বিয়ে ২০২২ সালে বেড়ে হয়েছে ৬.৫ শতাংশ; যা ২০১৮ সালে ছিল ৪.৬ শতাংশ। আর ১৮ বছরের আগে নারীদের বিয়ের হার ২০২২ সালে ৪০.৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে; যা ২০১৮ সালে ৩০.০ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২.১৮ শতাংশ পয়েন্ট করে বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড মহামারির প্রভাবে বাল্যবিবাহ আকস্মিকভাবে বেড়ে গেছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এবং জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের আরেকটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মহামারি চলাকালীন বাল্যবিবাহের কারণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মেয়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাইনুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '১৫ বছরের পূর্বে এবং ১৮ বছরের পূর্বে যারা আছে, তাদের মধ্যে বিয়ের হার বেড়ে গেছে। সেটির প্রভাব স্থূল বিয়ের হারের ওপর পড়েছে। বিয়ে করা মানুষের অধিকার, তবে সেটি হলো ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ বছর হলে এবং মেয়েদের ১৮ বছর। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে বাল্যবিবাহের অবস্থার উন্নতি না হয়ে অবনতি হয়েছে।'
প্রতি হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে বিয়ের সংখ্যাকে স্থূল বিয়ের হার বলা হয়। ২০২২ সালে বাংলাদেশে স্থূল বিয়ের হার এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ (প্রতি হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে ১৮.১) লক্ষ করা গেছে।
পল্লি অঞ্চলে স্থূল বিয়ের হার (১৯.৫) শহরাঞ্চলের (১৩.৮) তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। বিভাগীয় পর্যায়ের স্থূল বিয়ের হার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাজশাহী বিভাগে এর হার সর্বোচ্চ; প্রতি হাজারের বিপরীতে ২০.৬১। আর ঢাকা বিভাগে স্থূল বিয়ের হার সবচেয়ে কম, ১৫.৬২।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এএসএম আমানুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, 'পৃথিবীর যেকোনো দেশের জন্য স্থূল বিয়ের হার বেড়ে যাওয়া ভালো দিক, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এটি খারাপ। জাপানসহ বিভিন্ন দেশে স্থূল বিয়ের হার শূন্যের কাছাকাছি।
'কিন্তু বাংলাদেশে স্থূল বিয়ের হার বেড়ে গেলে বাল্যবিবাহ বেড়ে যায়। এর ফলে আর্লি প্রেগনেন্সি, মাতৃ ও নবজাতক মৃত্যু, শিশুর অপুষ্টি ও সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।'
বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে না পারলে এসডিসি অর্জন কঠিন হয়ে যাবে উল্লেখ করে তিনি বাল্যবিবাহ বন্ধে সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।
অধ্যাপক মাইনুল ইসলাম আরও বলেন, বাল্যবিবাহ কমাতে না পারলে বাংলাদেশ এসডিজির অর্ধেকের বেশি লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে না। এটি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট (জনমিতিক লভ্যাংশ) অর্জনের ক্ষেত্রেও একটি বড় বাধা, কারণ বাল্যবিবাহের কারণে সময়ের আগেই গর্ভধারণ করায় নারী আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সে কারণে তারা আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। এটি নারীর ক্ষমতায়নকে বাধাগ্রস্ত করে, সেইসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও পারিবারিক জীবনসহ সর্বত্র চ্যালেঞ্জ তৈরি করে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাল্যবিবাহ রোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্ব কার্যকরভাবে পালন করছে কি না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
অধ্যাপক মাইনুল ইসলাম বলেন, মেয়েরা স্কুলে না থাকার কারণে বাল্যবিবাহ বাড়ছে, যার ফলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার হার বেশি। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সুনির্দিষ্ট প্রচেষ্টা প্রয়োজন, কারণ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইনটি ধারাবাহিকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, বাল্যবিবাহ রোধে সরকার, সুশীল সমাজ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। তা না হলে দেশ বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে পড়তে পারে।
বিয়ের বয়স বৃদ্ধির সুফল তুলে ধরে বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিয়ের বয়স বাড়ালে তাড়াতাড়ি সন্তান জন্মদান ও প্রজনন হার কমে। এর ফলে তা জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি কমাতে সহায়ক হয়।
এক বছরে দ্বিগুণ হয়েছে বিবাহবিচ্ছেদের হার
বিবিএসের তথ্য বলে, ২০২২ সালে বিগত বছরের তুলনায় স্থূল তালাকের হার দ্বিগুণ হয়েছে (প্রতি হাজার জনসংখ্যায় ১.৪); যা ২০২১ সালে প্রতি হাজার জনসংখ্যায় ০.৭ ছিল।
পল্লি ও শহর উভয় এলাকায় তালাক বৃদ্ধির হার একই আদলে হয়েছে। স্থূল দাম্পত্য বিচ্ছিন্নের হারেও ২০২২ সালে উল্লম্ফন লক্ষ করা গেছে (প্রতি হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে ০.২৯); যা ২০২১ সালে ০.১৩ ছিল।
অধ্যাপক এএসএম আমানুল্লাহ বলেন, সামাজিক নিন্দার কারণে আগে বিচ্ছেদের হার কম ছিল। কিন্তু এখন নারীরা শিক্ষিত হচ্ছে, নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ছে। সে কারণে তারা ডিসিশন নিতে পারছে, বিচ্ছেদের হার বাড়ছে।
তিনি বলেন, আধুনিকায়ন, দ্রুত নগরায়ন, মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উঠে যাওয়ার প্রবণতা, সামাজিক অস্থিরতাও বিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী।
এই অধ্যাপক বলেন, বিচ্ছেদের হার কমানোর জন্য সামাজিক বন্ধন বাড়ানো দরকার। এর জন্য প্রয়োজন স্যোসাল ইঞ্জিনিয়ারিং, যা সময়সাপেক্ষ। তবে এখন থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।