শত বছর ধরে মেঘনার চরে টিকে আছে দেশীয় ধানের জাত, জলবায়ু পরিবর্তনেও স্থিতিশীলতার আশা
নানা প্রতিকূলতা ও জলবায়ুর কঠিন পরিবর্তন সত্ত্বেও শত বছর ধরে চরের জমিতে টিকে আছে কয়েকটি দেশিয় প্রজাতির ধান। যেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় লোতড় ধান, কালাগোরা ধান, গরছা ধান। বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েকটি জেলার নদী তীরবর্তী চর ও দ্বীপ চরে চাষ হয় এসব ধান। ধানগুলোর আকৃতি মোটা এবং রং কালো।
বাণিজ্যিকভাবে উন্নত জাতগুলোর বিপরীতে এসব জাতের উৎস একটি রহস্যই রয়ে গেছে। এসব জাত নিয়ে নেই বৈজ্ঞানিক গবেষণাও। কৃষকরা বলছেন, গবেষণার মাধ্যমে দেশিয় এ ধান থেকে জলবায়ু সহনশীল আরও কিছু উন্নত জাতের উদ্ভাবন করা যেতে পারে।
কেন এবং কীভাবে কৃষকরা শত বছর ধরে এসব ধান টিকিয়ে রেখেছেন এবং এসব জাতের সম্ভাবনা নিয়ে উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যার্ন্ডাড।
চার শামছুদ্দিনের বাসিন্দা কৃষক মো. মনির হোসেন (৪০)। সদ্য শেষ হওয়া আমন মৌসুমে তিন একর চরের জমিতে দেশিয় প্রজাতির লোতড়, কালাগোরা এবং গরছা ধানের চাষ করে এবার ৭৫ মণ ধান ঘরে তুলেছেন তিনি।
মনির জানান, গত প্রায় ১০ বছর ধরে চরের বিভিন্ন স্থানে এ প্রজাতির ধান চাষ করে আসছেন তিনি। তার পূর্ব পুরুষরা অর্ধশত বছর ধরে এ ধান চাষ করেছিলেন।
একই প্রজাতির ধান প্রতি বছর চাষ করার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, 'নদীর মধ্যবর্তী চরের জমিতে তীব্র লবণাক্ততা, জোয়ার, জলোচ্ছ্বাসে অন্য কোনো ধান জন্মায় না। এই জাতই তাদের একমাত্র ভরসা।'
যে কারণে কৃষকদের কাছে শত বছর ধরে এ ধান জনপ্রিয়
রায়পুর উপজেলার কানিবগার চরের বাসিন্দা মো. মোস্তফা বলেন, 'লবণ সহিষ্ণু, খরা সহিষ্ণু, জলাবদ্ধতা, ব্যাপক বাতাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে বাঁচতে পারে লোতড়, কালাগোরা এবং গরছা ধান। জমিতে কোনো সার ও কীটনাশক দিতে হয় না। কোনো রোগবালাই নেই। এক চাষের পরই ধান বুনে দিলেই কাজ শেষ। অন্যদিকে এসব ধান ২-৩টি প্রজাতি একসঙ্গে মিশ্র চাষ করা যায়। সে কারণেই প্রায় শত বছর ধরে কৃষকরা এ প্রজাতির ধানগুলো বাঁচিয়ে রেখেছেন।'
একই চরের বাসিন্দা মো. মোস্তফা (৫০) জানান, সব প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে এ ধানের ভালো ফলন হয়। ভাত খুবই সুস্বাদু এবং চাল দামি। একই ধানের বীজ রেখে পরের মৌসুমে আবার ধান চাষ করা যায়।
কত বছর ধরে এ ধানের চাষ হচ্ছে?
চর শামছুদ্দিন থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে আরেকটি দ্বীপ চর কাঁকড়া। দ্বীপটির কৃষক মো. নুরুল হক (৭৫) জানান, তার বাবা-দাদাদের সময়ও এসব ধানের চাষ হতো। ধানের এসব জাত চরের মানুষের কাছে শতাধিক বছরেরও বেশি সময় ধরে টিকে আছে।
একই কথা বলেন মেঘনার চরের কৃষক মো. সাইফুল ইসলাম, মো. আল আমিন, মো. মোক্তার, মো. দিদার ও হারুন।
কীভাবে ও কখন চাষাবাদ হয়?
রামগতি উপজেলার মেঘনা নদীর মধ্যবর্তী চর আবদুল্লাহর বাসিন্দা আলা উদ্দিন মাস্টার জানান, চরের জমিতে মাত্র একটা চাষ দিতে হয়। প্রতি বছরের জুন মাসের দিকে প্রতি ৮ শতকে এক কেজি শুকনো কিংবা ভেজানো ধান বুনে দিতে হয়। ৫-৬ দিনের মধ্যে চারা গাছ গজায়। মোটামুটি ১৮০ দিন পর ডিসেম্বর মাসের দিকে ধান পাকে। তখন কৃষক ধান কেটে ঘরে তোলেন।
খরচ ও ফলন
এ ধান চাষে খরচ বলতে একবার চাষ ও ধান কেটে ঘরে তোলা ছাড়া তেমন কোনো খরচ নেই। তবে মাঝে মধ্যে কেউ কেউ ইউরিয়া সার দিয়ে থাকে। প্রতি একর জমিতে ২৫-৩০ মণ ধান পাওয়া যায়।
চাষাবাদের জমি ও উৎপাদনের পরিমাণ
২০১৭ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর স্মল অ্যাটলাসের তথ্য অনুযায়ী, লক্ষ্মীপুরের চারটি উপজেলার মেঘনা নদীর ২০টি চরসহ ভোলা ও নোয়াখালীর সীমান্তবর্তী মেঘনা নদীতে প্রায় এক লাখ একর জমি রয়েছে। স্থানীয় কৃষকরা জানিয়েছেন, এসব চরের প্রায় ৬০ ভাগ জমিতেই এসব জাতের ধান চাষ হয়।
চর কাঁকড়ার কৃষক নেতা আহসান উল্লাহ হিরণ ও দিদার হোসেন জানান, সদ্য সমাপ্ত আমন মৌসুমে তাদের চরের প্রায় ২০০ একর জমিতে এ ধানের চাষ হয়েছিল। এতে কমপক্ষে ২০০ টন ধান পেয়েছেন কৃষকরা।
দেশিয় জাতের ধান হারিয়ে যাচ্ছে
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা সালেহ উদ্দিন পলাশ জানান, গত ৫-১০ বছরের মধ্যে তার লক্ষ্মীপুর থেকে আমন মৌসুমে ১৩টি এবং আউস মৌসুমে ৭টিসহ মোট ২০টি জাতের দেশিয় ধান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এগুলোর বীজও এখন নেই। বর্তমানে ঘিগজ, ভুষিহারা, কাজলশাইল, কালোজিরা, রাজাশাইল নামের পাঁচটি দেশিয় জাত খুবই কম পরিমাণে চাষ করছেন কৃষকরা। কিন্তু চরের জমিতে চাষাবাদের জন্য লোতড়, কালাগোরা, গরছা ধানকে টিকিয়ে রাখতে হবে। এ ধানগুলো জলবায়ু সহিষ্ণু। এগুলো নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে।
কেন এই দেশিয় ধানের জাত টিকিয়ে রাখা দরকার?
কৃষক সাইফুল ইসলাম জানান, উৎপাদন বাড়ানোর জন্য শুধু উফশী ও হাইব্রিড ধান চাষে মনোযোগ এবং ধান চাষে বহুজাতিক কোম্পানির ওপর নির্ভরতা এক সময় দেশের বির্পযয় ডেকে আনতে পারে। সেজন্য শত বছর ধরে জলবায়ুর সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা দেশিয় এসব ধানকে গবেষণা করে আরও শত বছর টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের লক্ষ্মীপুরের উপ-পরিচালক জাকির হোসেন বলেন, 'খরা, লবণ, ঝড় ও জোয়ারের পানির তীব্রতা সহ্য করা এসব ধান আমাদের কৃষির জন্য খুবই দরকার। এদের উৎপাদন সময় কমানোর জন্য এবং ফলন বাড়ানোর জন্য গবেষণা দরকার।'
পরিবেশ ও কৃষি বিষয়ক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সবুজ বাংলাদেশ এর গ্রীনল্যান্ড প্রকল্পের পরিচালক মো. ঈসমাইল হোসেন বাবু জানান, দেশিয় এসব ধানের জাতগুলোর গবেষণা, সংরক্ষণের জন্য জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা এবং কৃষকদের চাষে সরকার, কৃষি বিভাগ এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত সহযোগিতা প্রয়োজন।