গ্রিড সাবস্টেশন সক্ষমতার অভাবে বাঁশখালী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যহত
চট্টগ্রাম বাঁশখালীতে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কয়লাভিত্তিক বেসরকারি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা থাকলেও গ্রিড সাবস্টেশন সীমাবদ্ধতার কারণে এটি সক্ষমতার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করছে।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৫টায় এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কন্ট্রোলরুমে পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ নিয়ে যেতে সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও এখান থেকে ৪৫১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেওয়া হচ্ছে।
এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, এ সংকট কেটে যাবে। আগামী এপ্রিলের মধ্যে এ কেন্দ্র থেকে সরবরাহ পরিস্থিতি উন্নতি হবে। বিদ্যুৎ সঞ্চালনকারী কোম্পানি রাষ্ট্রায়ত্ত পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সাবস্টেশনের সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছে।
প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ এপ্রিলের মধ্যে সংকট কেটে যাবে বলে আশা করলেও আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
পিজিসিবির একটি সূত্র জানায়, বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের মদুনাঘাট হয়ে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাট গ্রিড উপকেন্দ্রের সক্ষমতা বাড়ানোর একটি প্রকল্প চলমান আছে। মদুনাঘাটে আগামী মে মাসের মধ্যে একটি এবং সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে আরেকটি ৪০০ কেভি ট্রান্সফরমার চালুর চেষ্টা চলছে। এ প্রকল্প শেষ হলে শুধু বাঁশখালী নয়, মাতারবাড়িতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদিত বিদ্যুতেরও পুরোটাই সঞ্চালন করা সম্ভব হবে।
বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পরিচালক ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান এ এস এম আলমগীর কবির টিবিএসকে বলেন, 'আঞ্চলিক চাহিদার ভারসাম্য রক্ষায় ব্যয়বহুল ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে হতো। এখন আর সেগুলোতে হচ্ছে না। এখন কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সব মিলিয়ে খরচ পড়ছে ১০-১২ টাকার মতো। আর ডিজেলে ২৫ টাকা এবং ফার্নেস অয়েলে ১৫ টাকা। ডিজেলের সঙ্গে তুলনা করলে প্রতি ইউনিটের খরচ কম পড়ছে ১৩ টাকার মতো। আমাদের প্ল্যান্টের মাসে প্রায় ৮৮ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। ইউনিট প্রতি ১৩ টাকা হারে সাশ্রয় ধরলেও সরকারের মাসে সাশ্রয় হবে এক হাজার ১৪৪ কোটি টাকার ওপরে।'
এসএম আলমগীর কবির এও জানান, আসন্ন গ্রীম্মে ডলার সংকটের কারণে কয়লা আমদানি করতে না পারলে এবং দেশে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিলে স্পট মার্কেট থেকেও কয়লা কিনে সাময়িকভাবে সমস্যা উত্তোরণের জন্য পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিল পরিশোধে সমস্যা হচ্ছে সরকারের। সরকারের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা দেনা।
বর্তমানে এসএস পাওয়ার সরকারের কাছে কত টাকা পাওনা জানতে চাইলে কেন্দ্রটির চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার মো. ইবাদত হোসেন ভুইয়া বলেন, 'এ পর্যন্ত আড়াই হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে পাবে এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট। পাওনা টাকা সরকার অল্প অল্প করে পরিশোধ করছে।'
২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। সাত বছর পর ২০২৩ সালের ১৪ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ শুরু হয়।
প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষের মতে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন কয়লা আনা হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে। প্রতিদিন দুটি ইউনিট চালাতে ১১ হাজার ৭৩৫ টন কয়লা লাগে। বছরে যার পরিমাণ ৪২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৩৪ টন।
কর্মকর্তারা জানান, আন্তর্জাতিক দামেই কয়লা কেনা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দাম কমবে, বাড়লে বাড়তি দরে নেওয়া হবে। ইন্দোনেশিয়ার দুইটি কয়লা কোম্পানির সঙ্গে ১৫ বছরের চুক্তি হয়েছে।
এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের তথ্যমতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় ২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ ২৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। প্রকল্পটিতে এস আলম গ্রুপের মালিকানা ৭০ শতাংশ এবং বাকি ৩০ শতাংশের রয়েছে চীনা কোম্পানি সেপকো থ্রি ও এইচটিজির। প্রকল্পটির জন্য বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।
এই ব্যয় আগামী ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে ওঠানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কম হলেও এর পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে। পরিবেশবিদরা সতর্ক করেছেন যে কয়লা জ্বালানোর ফলে নিঃসরিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড পৃথিবীতে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ ৬০ শতাংশেরও বেশি বাড়ানোর জন্য দায়ী।
প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্ল্যান্টে দুটি আধুনিক ফ্লু গ্যাস ডিসালফিউরাইজেশন (এফজিডি) সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। এই ব্যবস্থা ৯৯.৮৭% কার্বন নিঃসরণ প্রতিরোধে কার্যকরী।