বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গ্যাসের দাম বাড়ল, সামনে বাড়বে বিদ্যুতের দাম
সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রতি ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ৭৫ পয়সা বাড়িয়েছে। এর ফলে গ্যাসের দাম সরকারি, স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী (আইপিপি) ও রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোর জন্য ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য আড়াই শতাংশ বাড়তে যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) ট্যারিফ পুনর্নির্ধারণ করে এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে জানিয়েছে, নতুন এ দাম ফেব্রুয়ারি থেকেই কার্যকর হবে।
এ মূল্য সমন্বয়ের ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশন পেট্রোবাংলা বার্ষিক অতিরিক্ত এক হাজার ৩৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে পারবে বলে জ্বালানি বিভাগসূত্রে জানা গেছে।
এর আগে এ দিন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, মার্চ থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৪০ থেকে ৭০ পয়সা বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, শিল্প ও আবাসিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়বে না।
আরও পড়ুন: বিদ্যুতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ঘনমিটারে ৭৫ পয়সা বাড়াল সরকার
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার বিবেচনায় মার্চ থেকে প্রতি মাসে তেলের দাম সমন্বয় করা হবে।
মঙ্গলবারের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সরকারি, আইপিপি এবং রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৪ টাকা ৭৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৪ টাকা। পাশাপাশি ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনে (ক্যাপটিভ, ছোট ও বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র) গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
'কয়লা এবং ডলারের দাম বাড়ার কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে এ দাম কার্যকর হবে। আগামী তিনবছর ধরে বিদ্যুতের ভর্তুকি সমন্বয় করা হবে,' মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বলেন নসরুল হামিদ।
তিনি আরও বলেন, ৫০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারী গ্রাহকদের জন্য প্রতি ইউনিটের দাম ৩৪ পয়সা বাড়বে। আর যারা ৫০ ইউনিটের বেশি ব্যবহার করবেন, তাদের খরচের স্ল্যাব অনুযায়ী ৩৪ থেকে ৭০ পয়সা পর্যন্ত দাম বাড়বে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে পেট্রোবাংলার আয় বাড়বে প্রতি মাসে ৮৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
মঙ্গলবার পরে জারি করা আরেকটি বিবৃতিতে জ্বালানি বিভাগ গ্যাসের দাম বাড়ানোর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। তা-তে বলা হয়েছে, সরকার জনস্বার্থে ট্যারিফ পুনর্নিধারণ করেছে।
জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গ্যাস ব্যবহারকারীদের আট শ্রেণির গ্রাহক রয়েছে। গ্যাসের মোট ব্যবহারের মধ্যে ৩৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে, ২৩ শতাংশ শিল্পে, ১৮ শতাংশ ক্যাপটিভ বিদ্যুতে, ১০ শতাংশ গৃহস্থালিতে, ৭ শতাংশ সার উৎপাদনে, ৪ শতাংশ সিএনজিতে এবং ১ শতাংশ বাণিজ্যিক ও চা শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
আরও পড়ুন: মার্চ থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৭০ পয়সা পর্যন্ত বাড়ছে
প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন, আমদানি, সরবরাহ মূল্যের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের পার্থক্যের কারণে সরকারকে চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরে এ খাতে ছয় হাজার ৫৭০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।
এ মূল্য সমন্বয়ের ফলে এলএনজির [তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস] বর্তমান বাজারমূল্য ও ডলারের বিনিময় হার বিবেচনায় বিদ্যমান ভর্তুকি ছয় হাজার কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হতে পারে বলে জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ।
শিল্প, আবাসিক, সার উৎপাদন, সিএনজি, বাণিজ্যিক এবং চা শিল্পে মূল্য সমন্বয় অপরিবর্তিত রয়েছে।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৭১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের দৈনিক চাহিদা দুই হাজার ৩১৬ ঘনফুট। তবে বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকায় নিয়মিত চাহিদার সমান গ্যাস সরবরাহ করতে হয় না। পেট্রোবাংলার ২৭ ফেব্রুয়ারির গ্যাস সরবরাহের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় ৮৬১ ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। এ দিন ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ছিল।
একটি স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একজন উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাবে। বর্তমানে মোট বিদ্যুতের ৪৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে।
'ফলে গ্যাসের দাম ৫ শতাংশের বেশি বাড়লে উৎপাদন খরচও একই হারে বাড়বে। এ কারণে সরকারের উচিত দ্রুত বিদ্যুতের দাম বাড়ানো,' বলেন তিনি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশের উপদেষ্টা শামসুল আলম টিবিএসকে বলেন, বিদ্যুতের ঘাটতি বাড়ছে। আবার বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামালের দামও বাড়ছে। আগামীতে এলএনজি ও কয়লার দাম বাড়লে আবারও সমন্বয় করা হবে।
'এতে বিদ্যুতের দামও বাড়বে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম আমদানি করা বিদ্যুতের দামের চেয়ে বেশি হবে। পরবর্তীসময়ে বিদ্যুতের আমদানিও বাড়বে,' উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন তিনি।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর আলামীন টিবিএসকে বলেন, যেকোনো পর্যায়ে যেকোনো মূল্যবৃদ্ধি হলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। বিদ্যুতের জন্য গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে কারখানার উৎপাদন খরচ বাড়বে। তবে এর চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত হচ্ছে না। ফলে কারখানাগুলো প্রয়োজন অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদনে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে।
'এখন যেহেতু দাম বাড়ানো হয়েছে, গ্যাস সরবরাহের উন্নতি না হলে এটি লোকসানকে আরও বাড়াবে। যা ব্যবসার জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। ভবিষ্যতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি কেবল চাপ বাড়াবে,' তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার টিবিএসকে বলেন, বর্তমানে আমদানি করা এলএনজি এবং দেশে উৎপাদিত গ্যাস উভয়ই একসঙ্গে সরবরাহ করা হয়।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, সরকারি সংস্থা [পেট্রোবাংলা] যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এসব লোকসান কমাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন যতটা দাম বাড়ানো হয়েছে, তা-তেও লোকসান পুরোটা কাটিয়ে ওঠা যাবে না। তবে ধীরে ধীরে সমন্বয় করা হবে।
বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফয়সাল খান টিবিএসকে বলেন, 'ভর্তুকির ওপর নির্ভরতা কমাতে আমরা বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ট্যারিফ সমন্বয়কে স্বাগত জানাই।'