উচ্চশিক্ষায় বাংলায় পাঠ্যবই: ১৬.৫০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব বাংলা একাডেমির
স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রমে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়াতে পাঠ্য ও সহায়ক হিসেবে ৩২৫টি বই বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতে চায় বাংলা একাডেমি।
এসব বইয়ের মধ্যে রয়েছে জীববিজ্ঞান, কৃষি, চিকিৎসা, ভৌত বিজ্ঞান, প্রকৌশল, রচনাবলি, গবেষণামূলক, স্মারক, জীবনী ইত্যাদি।
সেইসঙ্গে নতুন লেখক, গবেষক ও সংকলক তৈরি করতে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকুরিরত বা অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্য ২৪০টি প্রশিক্ষণের আয়োজনও করতে চায় সংস্থাটি।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পাঠানো 'ভাষা, সাহিত্য, পাঠ্য ও সহায়ক গ্রন্থ প্রণয়ন ও প্রকাশনা' শীর্ষক এই প্রকল্পের প্রস্তাবের ওপর ইতোমধ্যেই পরিকল্পনা কমিশনের আয়োজনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সভায় প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচন, ব্যক্তি পরামর্শক খাতে ব্যয় বাদ দেওয়া, বিভিন্ন খাতের ব্যয় যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনাসহ বেশ কয়েকটি পরামর্শ পরিপালন সাপেক্ষে প্রকল্পটি অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এদিকে সভায় বিভিন্ন খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ সত্ত্বেও তিন মাসে প্রায় ২৭ লাখ টাকা বেতন দিয়ে একজন পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাবের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।
পিইসি সভায় বলা হয়েছে, সেমিনার ও কনফারেন্স খাতে ২৬.৭৬ লাখ টাকা, প্রশিক্ষণ খাতে ২.০৬ কোটি টাকা, গাড়ি বরাদ্দ সত্ত্বেও ভ্রমণ খাতে ১৫.৮০ লাখ টাকা, প্রশিক্ষণ সামগ্রী খাতে ২২.১০ লাখ টাকার বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে, যা অপ্রয়োজনীয়।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহাম্মদ নূরূল হূদা উল্লেখ করেন, উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন স্তরে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি লালনের সুযোগের অভাব রয়েছে।
তিনি বলেন, 'উচ্চশিক্ষার কোনো পর্যায়েই বাংলা ভাষার ব্যবহার না থাকায় পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা, পারিভাষিক শব্দ প্রভৃতির অভাব রয়েছে।'
প্রকল্পটির বাস্তবায়নের কাজ শেষ হলে গবেষণা ও প্রকাশনাকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক ও মননশীল চর্চাকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বর্তমানে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত কারিকুলাম জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তত্ত্বাবধানে রচিত হয়। তবে উচ্চ মাধ্যমিকে শুধু বাংলা ও ইংরেজি বই এনসিটিবির মাধ্যমে লেখা হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'অনেক শিক্ষাবিদ নিজ উদ্যোগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের বই লিখেন। এখানে এনসিটিবির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এক্ষেত্রে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই বই পাওয়া যায়। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রকাশ হওয়ায় দেখা যায়, সব বই-ই মানসম্পন্ন হয় না।'
বাংলা একাডেমির এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, 'এই পর্যায়ে যদি বাংলা একাডেমির মানসম্পন্ন বই থাকে, তাহলে উচ্চশিক্ষার এই ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা হবে। এতে ব্যক্তি উদ্যোগে যারা বই লিখে থাকেন, তারা আরও মানসম্পন্ন বই লিখতে বাধ্য হবেন।'
তবে তার পরামর্শ হলো- কোনো বইকে বাধ্যতামূলক না করা।
তিনি বলেন, 'উচ্চশিক্ষার এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীর পছন্দের ভাষায় বই বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। তারা পছন্দমতো সেই ভাষার বই বেছে নেবে যা তাদের চাকরি, গবেষণা ও কর্মক্ষেত্রের জন্য সহায়ক হবে।'
এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে উচ্চ মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশ এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও কর্মশালার আয়োজন করা।
প্রকল্পটির বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬.৫০ কোটি টাকা, যার পুরোটাই সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বাংলা একাডেমিকে অনুদান হিসেবে দেওয়া হবে। চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে চলতি বছরের জুন থেকে ২০২৭ সালের জুনের মধ্যে পুরো কাজ শেষ করা হবে।
প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ ও এর ব্যবস্থাপনা আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন নয়।
এতে আরও বলা হয়, সারাদেশের বস্তুগত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নানামাত্রিক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে চলেছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে তা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন প্রকল্পের চেয়েও অধিক হারে জাতীয় উন্নয়নের সম্পৃক্ততায় ভূমিকা রাখবে।
প্রকল্পের মূল উদ্দেশে বলা হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, লেখক, গবেষকদের সময়োপযোগী এবং সহজ সমাধানের ভিত্তিতে গুণগত মান বজায় রেখে গ্রন্থ প্রণয়ন ও প্রকাশ করে গ্রাহকদের নিকট পৌঁছে দেওয়া হবে।
বইগুলোর প্রচারণা চালাতে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও কর্মশালার আয়োজন করা হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে জীববিজ্ঞান, কৃষি, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ভৌতবিজ্ঞান, প্রকৌশল, কারিগরি বিষয়ে বই প্রকাশ করা হবে।
প্রকল্পের প্রস্তাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিভিন্ন খাতে ৩২৫ টি বইয়ের মোট দুই লাখ ৫৬ হাজার ২৫০টি কপি প্রকাশ করতে ব্যয় হবে ৯.২৪ কোটি টাকা। রচনাবলি গ্রন্থগুলোর সম্পাদনা সম্মানী বাবদ ৪০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে।
লেখক পরিবারের রয়্যালটি বাবদ রাখা হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা করে। গবেষণামূলক বইগুলোর লেখকের রয়্যালটি বাবদ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দের পাশাপাশি পাণ্ডুলিপি পরীক্ষকের জন্য রাখা হয়েছে ১০ হাজার টাকা।
এছাড়াও স্মারক গ্রন্থে বিভিন্ন সম্মানী বাবদ রাখা হয়েছে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা।
জীবনীগ্রন্থে পাণ্ডুলিপি পরীক্ষক ও রয়্যালটি বাবদ থাকছে ৪০ হাজার টাকা।
এর বাইরে সংকলন গ্রন্থে এক লাখ ৩০ হাজার টাকাসহ প্রতিটি পর্যায়েই লেখন, পাণ্ডুলিপি পরীক্ষক, প্রচ্ছদ শিল্পীদের বরাদ্দ রাখা হয়েছে।