জ্বর, হাঁচি-কাশি ছাড়ছে না কেন? এবারের ফ্লুর ধরন কি ভিন্ন?
মাথা ভারি হয়ে থাকা, সর্দি, কাশি, হাঁচি, জ্বর– ইদানিং একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতি ঘরেই মিলছে এমন রোগী। হাসপাতালের আউটডোর ও চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বারে বাড়ছে এসব রোগীর ভিড়।
চিকিৎসকেরা বলছেন, অন্যান্য সময়ের তুলনায় এবারের ফ্লুর ধরন ভিন্ন। এটি আগের তুলনায় বেশি আক্রমণাত্মক এবং রোগীরা এবার দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন। ধুলাবালি ও ঋতু পরিবর্তনের কারণে ভাইরাসজনিত এসব রোগ বাড়ছে। এ থেকে সুরক্ষিত থাকতে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
অন্যান্য সময়ের তুলনায় এবার বাংলাদেশে ফ্লুর ধরন ভিন্ন বলে মনে করছেন প্রিভেন্টিভ মেডিসিন স্পেশ্যালিস্ট ড. এম এইচ চৌধুরী লেনিন। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "শীতকাল শেষে আবহাওয়ায় যখন পরিবর্তন আসে, অর্থাৎ দিনের বেলা গরম ও রাতের বেলা ঠাণ্ডা হয়– তখন ফ্লু অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু এবারে বাংলাদেশে ফ্লুর ধরনটা ভিন্ন। এটি যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক এবং যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তারা তীব্র মাথাব্যথা এবং কাশিতে ভুগছেন; আর কাশিও স্থায়ী হচ্ছে অনেকদিন।।"
''প্রাইভেট চেম্বারে, হাসপাতালে এমনকি ওভার দ্য ফোনেও আমরা প্রচুর রোগী পাচ্ছি। এমন কোনো পরিবার দেখছিনা যেসব পরিবারে এক দুই জন রোগী নেই। কেউ কেউ এক থেকে দেড় মাস ধরেও অসুস্থ্য থাকছে,' যোগ করেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বি চৌধুরী বলেন, "এই মুহূর্তে কোনো একটা ভাইরাল ফ্লু চলছে, এছাড়া মিক্সার কিছু ভাইরাস যেমন– কোভিড রিলেটেড কেসও আছে, আবার ইনফ্লুয়েঞ্জা হচ্ছে। কারো কারো ক্ষেত্রে হার্টে পানিও জমছে, কাশিটা একদম যেতে চাচ্ছেনা, স্টেরয়েড না দেওয়া পর্যন্ত রেসপন্স করছেনা এমনও হচ্ছে। স্বাভাবিক ইনহেলার বা অন্যান্য সিমটেমেটিক ওষুধ দিয়ে রোগ সারছেনা। এরকম আগে দেখিনি। এবারের ফ্লুটা বেশি খারাপ; ফ্যাটালিটি নেই, কিন্তু রোগীরা দীর্ঘদিন কষ্ট পাচ্ছে।"
''বেসিক্যালি এটি একটি ফ্লু। কিন্তু কী ভাইরাসের কারণে এটি ছড়াচ্ছে, তার কোনো সার্ভিলেন্স যেহেতু হয়নি, তবে ধরে নিতে হবে এটি একটি ভাইরাল ফ্লু। এর সাথে কোভিডও আছে, অন্যান্য ভাইরাসও আছে," বলেন তিনি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহনূর সারমিন টিবিএসকে বলেন, "হাসপাতালে ও চেম্বারে কাশি, জ্বরের অনেক রোগী পাচ্ছি। বেশিরভাগ রোগী আউটডোরে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে, তবে নিউমোনিয়ার রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। এবারের সমস্যা হলো মেডিসিনে কাশির ইমপ্রুভ হচ্ছেনা। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ্য থাকছে রোগীরা। ঘরে ঘরে ঠাণ্ডা, কাশির রোগী; কিন্তু স্লোলি ইমপ্রুভ করছে।"
কেনো এমন হচ্ছে?
ডা. এম এইচ চৌধুরী লেনিন বলেন, "এর পিছনে দুটি কারণ– প্রথমটি হলো, বাংলাদেশের বায়ু দূষণ; বিশেষ করে ঢাকা শহরের বায়ু দূষণ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বেড়েছে। তার কারণে আমাদের শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা তীব্রতর হচ্ছে। আরেকটি কারণ হলো, যেই ভাইরাসগুলো দিয়ে এ ফ্লুগুলো হতো, সেই ভাইরাসগুলোর চরিত্রে সম্ভবত পরিবর্তন এসেছে। তারা মিউটেশনের মধ্য দিয়ে আরও বেশি আক্রমণাত্মক হয়েছে।"
তিনি আরো বলেন, বায়ু দূষণকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা কমবে। অন্যদিকে ভাইরাসের ধরণে পরিবর্তন আসছে কিনা তা দেখতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে জিনোম সিকুয়েন্সিং করে ভাইরাসের পরিবর্তনের ধরণ দেখতে হবে।
তবে ভাইরাসের ধরণে কোনো পরিবর্তন আসছে কিনা, তা নিয়ে এখনো কোনো কাজ করেনি ইনস্টিটিউট অফ এপিডেমিওলজি ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ (আইইডিসিআর)।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, কোনো ধরনের আউটব্রেক ছাড়া আইইডিসিআর সার্ভিলেন্স করেনা। এখন ইনফ্লুয়েঞ্জার সময় নয়, এখনও কোভিড হচ্ছে অনেকের।
হাসপাতালে রোগীর চাপ
শ্যামলীর ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালের আউটডোরে এখন প্রতিদিন ৬০০ এর বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। ডিসেম্বরে প্রতিদিন রোগী আসার সংখ্যা ছিল ৩০০-৪০০ এর মধ্যে। এই হাসপাতালে বেড সংখ্যা ১৫০টি। ফেব্রুয়ারি থেকে হাসপাতালটিতে ইনডোরে বেড খালি থাকছেনা।
হাসপাতালের ডেপুটি ডিরেক্টর ডা. আয়েশা আখতার বলেন, "গত ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের হাসপাতালে ৮,০০০ রোগী ভর্তি ছিল, ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারিতে যে সংখ্যা ছিল ৬,১৩৬। এবার আমরা টিবিার পাশাপাশি অ্যাজমা, হাঁচি-কাশিসহ শ্বাসতন্ত্রের রোগী বেশি পাচ্ছি। এর আগে কখনো আমাদের বেড সংকট হতোনা। সিজন চেঞ্জ, দূষণের কারণে এবার রোগী বেশি।"
বিএসএমএমইউ-এর ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টে প্রতিদিন ১৫০-২০০ রোগী ঠাণ্ডা-জ্বর-শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে আসছে বলে জানিয়েছে ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টের চিকিৎসকেরা।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের আউটডোরে অন্যান্য সময়ে দিনে গড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ জন রোগী আসলেও এখন সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১,৩০০ জনে। এরমধ্যে সর্দি-কাশি ও ঠাণ্ডায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যাই বেশি বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম।
সুস্থ থাকতে যা করতে হবে
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, দূষণ থেকে বাঁচতে বাইরে বের হলে মাস্ক পরতে হবে। বয়স্ক ও শিশুদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। রাস্তার ধারে বা খোলা জায়গার খাবার খাওয়া যাবে না।
ডা. ফজলে রাব্বি চৌধুরী বলেন, বাইরে বের হলে মাস্ক পরতে হবে। যার সর্দি কাশির সিমটম আছে তাকে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে, যাতে অন্যদের মধ্যে না ছড়ায়। বয়স্কদের ঘরে রাখতে হবে, যাতে বেশি ভীড়ে না যায়, বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। হেলথ হাইজিন মেনে চলতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত পর্যাপ্ত পানি পান, শাক সিবজি খেতে হবে।
''মাথা ভারি হয়ে থাকলে মেনথল নিলে অনেক সময় রিলিফ হয়– তাই মেনথল নিতে পারেন রোগীরা, প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া নাক বন্ধ হয়ে গেলে স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে," যোগ করেন ডা. ফজলে রাব্বি চৌধুরী।