৩০ বছর পর উন্মোচিত হওয়া সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলায় ২ জনের যাবজ্জীবন
রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় সগিরা মোর্শেদ হত্যাকাণ্ড মামলায় দুই আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও তিন জনকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত।
বুধবার (১৩ মার্চ) ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩ এর বিচারক মোহাম্মদ আলী হোসাইনের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন।
কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন– আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান ও মারুফ রেজা।
কারাদণ্ডের পাশাপাশি তাদেরকে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডও দেওয়া হয়েছে। এই অর্থ অনাদায়ে তাদের আরও ৬ মাসের কারাভোগ করতে হবে বলে রায়ে উল্লেখ করেন বিচারক।
এদিকে, অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মামলার তিন আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত। খালাসপ্রাপ্তরা হলেন- নিহতের ভাশুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী, তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহীন ও মন্টু মন্ডল।
দণ্ডপ্রাপ্ত আনাস মাহমুদ নিহত সগিরা মোর্শেদের ভাশুর ডা. হাসান আলী চৌধুরীর শ্যালক।
এর আগে, গত ২৫ জানুয়ারি একই আদালত রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে এ মামলায় রায়ের জন্য দিন ধার্য করেন। তবে রায় প্রস্তুত না হওয়ায় দুই দফায় রায় ঘোষণা পিছিয়ে দেন আদালত।
বাদীপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ গণমাধ্যমকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
মামলার আসামিরা হলেন- নিহতের ভাশুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহীন, শ্যালক আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান, মারুফ রেজা ও মন্টু মন্ডল।
পারিবারক দ্বন্দ্বের জের ধরে ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই বিকালে সিদ্ধেশ্বরীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে সগিরা মোর্শেদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যাওয়ার পথে প্রকাশ্য দিবালোকেই অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সগিরা।
ওই ঘটনায় রমনা থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন সগিরার স্বামী সালাম চৌধুরী।
মামলাটি ২৫ জন তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করে গড়ে একজন করে আসামি গ্রেপ্তার করেন।
১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি মন্টু নামে একজনকে আসামি করে চার্জশিট দেয় পুলিশ।
এরপর হাইকোর্টের একটি আদেশে মামলার অধিকতর তদন্ত সীমাবদ্ধ থাকায় গত ৩০ বছরেও হত্যা মামলাটির সুরাহা করতে পারেনি তদন্ত সংস্থাগুলো।
যেভাবে উন্মোচিত হলো হত্যার রহস্য
চলতি বছরের ২৬ জুন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নিলে পরিস্থিতি বদলে যায়।
একইসঙ্গে মামলাটি অধিকতর তদন্ত করতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের নির্দেশনা পাওয়ার মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে মামলাটি নিষ্পত্তি করতে পেরেছে পিবিআই।
কোনো ফরেনসিক তদন্ত এবং আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা ছাড়াই পিবিআই প্রায় তিন দশক আগের তদন্ত থেকে পাওয়া ছোট ছোট সূত্রগুলোকে কেন্দ্র করে মামলাটির সমাধান করেছে।
ডিআইজি ও পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "১৯৯১ সালে এ মামলার অধিকতর তদন্তে বিচারিক আদালতের নির্দেশনা চ্যালেঞ্জ করে আসামি মারুফ রেজার করা আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দেন। সেই সময় যে পর্যন্ত তদন্ত করা হয়েছিল, সেখান থেকেই আমরা শুরু করেছি।"
১৯৯০ সালে মিন্টু ওরফে মন্টু ওরফে মৌরনের বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
এ মামলায় আটজন সাক্ষীর জবানবন্দি রেকর্ড করেন আদালত।
নিম্ন আদালতে যখন সাক্ষ্যগ্রহণ চলছিল তখন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসানের আত্মীয় মারুফ রেজার নাম প্রকাশ পায়।
এরপর নিম্ন আদালত ১৯৯১ সালের ২৩ মে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন। পরে নিম্ন আদালতের ওই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন মারুফ রেজা।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ সালের ২ জুলাই হাইকোর্ট এ মামলার বিচারিক কার্যক্রম ও অধিকতর তদন্তের ওপর স্থগিতাদেশ দেন।
মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম বলেন, ওই সময় মারুফ রেজাকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) আটক করে।
তিনি বলেন, "সাক্ষীরা জবানবন্দি দেওয়ার সময় মারুফ রেজার নাম উঠে আসে। গোয়েন্দা পুলিশ তাকে আটক করলেও পরে ছেড়ে দেয়। তাকে ছেড়ে দিয়ে মামলাটি ছিনতাই উল্লেখ করে চার্জশিট দেওয়ার জন্য কিছুটা চাপ থাকতে পারে।"
তাই পিবিআইয়ের তদন্তের শুরু থেকেই সন্দেহভাজনের তালিকায় মারুফ রেজার নাম ছিল।
বনজ কুমার মজুমদার আরও বলেন, এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেকের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, "প্রথমে আমরা বাদী ও নিহতের স্বামী আব্দুস সালাম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তার সঙ্গে কথা বলে আমরা প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী সালাম মোল্লা নামে এক রিকশাচালকের কথা জানতে পারি।"
পিবিআই সগিরা ও তার শ্বশুরবাড়ির মধ্যে কিছু সাংসারিক ঘরোয়া কলহের বিষয়েও জানতে পারে।
পিবিআই প্রধান বলেন, কয়েক মাস চেষ্টা করে আমরা সেই রিকশাচালককে খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছি।
৫৬ বছর বয়সী সালাম মোল্লা পিবিআইয়ের তদন্তে প্রথম সাফল্য তুলে ধরেন।
তিনি পিবিআইকে বলেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে সাগিরা মোটরসাইকেল আরোহীদের একজনকে শনাক্ত করেন, যে তাকে বন্দুক দিয়ে গুলি করে।
সালাম মোল্লা পিবিআইকে আরও বলেন, হামলাকারীদের একজনকে উদ্দেশ্য করে সগিরা বলেছিলেন, 'আরে, আমি তোমাকে চিনি! তুমি এখানে কেন?'
এতে পিবিআই সফলতা পায়। হত্যার আগে সগিরা যাকে চিনতে পেরেছে তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে পিবিআই।
তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, পিবিআই তদন্ত শুরুর আগে মামলাটি ছিনতাইয়ের মামলা হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল।
পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম বলেন, "রিকশাচালক আমাদের বলেছেন যে এটা যদি শুধু ছিনতাইয়ের ঘটনা হতো তাহলে ছিনতাইকারীকে শনাক্ত করতে পারতেন না সগিরা। তাই পারিবারিক কলহ ও তিন জা'র মধ্যে বিবাদের দিকে নজর দিয়েছি।"
তিনি বলেন, "আমরা পারিবারিক বিবাদের খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করেছি এবং সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সূত্র পেয়েছি।"
হাসান আলী চৌধুরী, তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা চৌধুরী, তার ভাই আনাস মাহমুদ রেজওয়ান ও ড. হাছানের রোগী মারুফ রেজাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করি।
তিনি বলেন, "অবশেষে আমরা যখন একে একে সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করছিলাম তখন আমরা জানতে পারি পারিবারিক কলহের জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।"
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, "ওই চিকিৎসক দম্পতি ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে মারুফ রেজাকে ভাড়া করেন এবং আনাস মাহমুদ রেজওয়ানও হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন।"
পিবিআই প্রধান আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত রিভলভার ও মোটরসাইকেলের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর কোনো হদিস তারা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, "মারুফ রেজা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, তিনি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার সন্ত্রাসী হরহার মুন্নার কাছ থেকে রিভলবারটি সংগ্রহ করেছিলেন। আমরাও তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা জানতে পারি দুই বছর আগে বন্দুকযুদ্ধে তার মৃত্যু হয়েছে।"
১৯৯০ সালে পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রে উল্লিখিত মিন্টুর সঙ্গে সগিরা হত্যার কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি পিবিআই।