দীঘিপাড়া খনি থেকে ৯ কোটি টন কয়লা উত্তোলনের পরিকল্পনা সরকারের
দিনাজপুরের দীঘিপাড়া কয়লাখনি থেকে ৯ কোটি টন কয়লা উত্তোলনের পরিকল্পনা করছে সরকার। আগামী ৩০ বছরে এ পরিমাণ কয়লা উত্তোলন করা হবে, যার বর্তমান বাজারমূল্য ১৬ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৬৭ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ জ্বালানি মূল্যের কারণে স্থানীয় শিল্পখাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে করতে দেশ যখন ব্যাপক সমস্যায় রয়েছে, তারমধ্যে এটি একটি সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে।
এই খনি নির্মাণ শুরুর পর কয়লা উত্তোলন শুরু করতে প্রায় আট বছর লাগবে। দীঘিপাড়া খনিতে মোট ৭০ কোটি ৬০ লাখ টন কয়লা মজুত রয়েছে বলে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল) এর সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় উঠে এসেছে।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ''দেশের কয়লাক্ষেত্রসমূহের বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাব্য করণীয় সম্পর্কিত উপস্থাপনা'' শিরোনামে সভায় পেট্রোবাংলা উপস্থাপিত প্রতিবেদনে এই পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ শুধু বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির মধ্যভাগের অংশ থেকে থেকে কয়লা উত্তোলন করছে। ২০০৫ সাল থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত এ খনি থেকে এক কোটি ৪২ লাখ টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের জ্বালানি সরবরাহ ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়া এবং স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ কমে যাওয়ায় নতুন খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ খুবই যৌক্তিক।
বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে প্রতিবছর কয়লার প্রয়োজন ৩.৬ মিলিয়ন টন, যার মূল্য প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম টিবিএসকে বলেন, 'দেশের কয়লার জোগান দরকার। আমরা বড়পুকুরিয়া থেকে যে অল্প পরিমাণ কয়লা উত্তোলন করি, তার সঙ্গে দীঘিপাড়া থেকে কয়লা উত্তোলন করলে– কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার চাহিদা মেটানো সম্ভব। এতে জ্বালানিটি আমদানির প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।'
এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে দীর্ঘমেয়াদ ধরে কয়লার জোগান দিতে হবে। তাই দেশের কয়লার মজুদ থেকে উত্তোলন করে আমদানি কমাতে হবে। সেই হিসাবে, নতুন ক্ষেত্র থেকে কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা যৌক্তিক হবে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের এখন এই পথে যাওয়া উচিত'- জানান বদরুল ইমাম।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশের পাঁচটি কয়লা খনিতে মোট মজুদের ২০ শতাংশ উত্তোলন করা যাবে। দেশে অবশিষ্ট উত্তোলনযোগ্য কয়লার মজুদের পরিমাণ ১৫৫ কোটি টন (১৫৫০.৩৬ মিলিয়ন), যা ৩৯.৬৯ টিসিএফ প্রাকৃতিক গ্যাসের সমান। বর্তমানে দেশে অবশিষ্ট প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদের পরিমাণ ৯.৩৮ টিসিএফ।
দীঘিপাড়ার কয়লা উত্তোলনের ব্যয় ও অর্থায়ন
পেট্রোবাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীঘিপাড়ায় কয়লা উত্তোলনে মূলধনী ব্যয় হবে ১৬৪ কোটি ডলার। এছাড়া, প্রতি টন কয়লা উত্তোলনে পরিচালন ব্যয় হবে ৫৩ ডলার। ফলে প্রতি টন কয়লা উত্তোলনে মোট খরচ হবে ১৬০ ডলার। প্রতিটন কয়লার বিক্রয়মূল্য ১৭৬ ডলার হিসাবে নেট প্রেজেন্ট ভ্যালু দাঁড়ায় ১৬৮ মিলিয়ন ডলার।
এই কয়লা উত্তোলনে সম্ভাব্য অর্থায়নকারী হিসেবে ডেভেলপার কাম অপারেটরের বিনিয়োগ, সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট, জয়েন্ট ভেঞ্চার, বৈদেশিক উৎস বা সরকারি তহবিল বিনিয়োগের কথা উল্লেখ করেছে পেট্রোবাংলা।
দীঘিপাড়া থেকে কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠান সিএমসি, যারা বর্তমানে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করছে। সমীক্ষা প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে লাভজনক বিবেচিত হলে জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি গঠনের প্রস্তাব করেছে চীনা কোম্পানিটি।
মাল্টি-স্লাইস লংওয়াল পদ্ধতি
পেট্রোবাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দীঘিপাড়া কয়লা খনির এলাকা ১১ বর্গকিলোমিটার। আর ৩২০ থেকে ৫০৬ মিটার গভীরতায় রয়েছে কয়লার মজুদ। ২০২০ সালে এ খনির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান যুক্তরাজ্যের ডিএমটি কনসাল্টিং লিমিটেড ২০২২ এর আগস্টে ফিজিবিলিটি স্টাডি প্রতিবেদনের পর্যালোচনা সম্পন্ন করে ইতিবাচক ফলাফল দিয়েছে। তারা ভূগর্ভস্থ 'মাল্টি-স্লাইস লংওয়াল টপ কোল কেভিং মাইনিং' পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের জন্য সুপারিশ করেছে।
এই সুপারিশের প্রেক্ষিতে, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের কাছে তিনটি বিকল্প প্রস্তবনা দিয়ে পেট্রোবাংলা বলেছে, 'মাল্টি-স্লাইস লংওয়াল টপ কোল কেভিং মাইনিং' পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের জন্য দ্রুত উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। অথবা ভূ-অবনমন সীমিত রেখে 'রুম অ্যান্ড পিলার উইথ স্টোয়িং' পদ্ধতি অথবা 'আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন' করা যাবে কি-না, সে বিষয়ে একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) করা যেতে পারে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, দীঘিপাড়ায় উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি গ্রহণ করা ঠিক হবে না। মাল্টি-স্লাইস লংওয়াল বা বহুস্তর বিশিষ্ট ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতি গ্রহণ করলে তা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে।
মাল্টি-স্লাইস লংওয়াল পদ্ধতির ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, সুড়ঙ্গ করে মাটির ভেতরে কয়লার স্তরে পৌঁছানো হয়। খনিতে কয়লার স্তর ২০ মিটার গভীর হলে প্রথমে উপরের ৩ মিটার উত্তোলন করা হয়। এবার পরের ৩ মিটার বাদ রেখে আবার তার নিচের ৩ মিটারের স্তর উত্তোলন করা হয়। এভাবে একাধিক স্তরে কয়লা উত্তোলন পদ্ধতিকে মাল্টি-স্লাইস লংওয়াল পদ্ধতি বলা হয়।
পরিবেশগত প্রভাব
পেট্রোবাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করতে ১৩.৯৮ বর্গকিলোমিটার জমি লিজ বা অধিগ্রহণ করতে হবে। এই জমিতে আগামী একশ বছরে উৎপাদিতব্য ধানের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ হাজার ৯ কোটি টাকা।
কয়লাখনির জন্য ২ হাজার ৭৯৮টি পরিবারের প্রায় ১১ হাজার ১১০ জন এলাকাবাসীকে পুনর্বাসন করতে হবে। ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের জন্য মাইনিং সিটি নির্মাণ করে আবাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। খনি কার্যক্রমের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের সরকারি আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এছাড়া, স্থানীয় জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হবে।
এই খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের একটি পরিবেশগত প্রভাব পর্যালোচনা ও তার ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান) করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, খনির ভেতরে ঘন্টায় সর্বোচ্চ ২০ হাজার ঘনমিটার পানির প্রবাহ হতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণ করতে কাট অব ওয়াল বা সিলিং ওয়াল নির্মাণ করা হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সিলিং ওয়াল নির্মাণ করে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে খনি পরিচালিত হওয়ার উদাহরণ তুলে ধরে পেট্রোবাংলা বলেছে, জার্মানির লুসাটিন লিগনাইট ওপেন কাট মাইন, জেন্সওয়াল্ডে ওপেন কাট মাইন এবং কানাডার ডিয়াভিক ডায়মন্ড মাইন সিলিং ওয়াল নির্মাণ করে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করেছে।
পেট্রোবাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিলিং ওয়াল ব্যবহারের ফলে খনি এলাকার বাহিরের পানির স্তর অবনমিত হবে না। ফলে পরিবেশের উপর কোন বিরূপ প্রভাব পড়বে না। সিলিং ওয়াল নির্মাণের পর ভূগর্ভ হতে সর্বোচ্চ পানি নিঃসরণ হবে ঘণ্টায় ২ হাজার ৫১৬ ঘনমিটার।
গত ১৬ জানুয়ারি এক ব্রিফিংয়ে নসরুল হামিদ জানান, কৃষিজমি নষ্ট না করে ও পরিবেশের ক্ষতি না করে যতটুকু পারা যায় কয়লা উত্তোলনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে নির্দেশনা চাওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিলে কয়লা উত্তোলন শুরু হবে বলে জানান তিনি।
অন্যান্য কয়লাখনির অবস্থা
পেট্রোবাংলার প্রতিবেদনে, দেশের অন্যান্য কয়লা খনির বর্তমান অবস্থার কথাও বলা হয়েছে এবং কয়লা উত্তোলনের জন্য সম্ভাব্য পদক্ষেপের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তরাংশ থেকে রুম এন্ড পিলার বা এলটিসিসি মাইনিং পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে পেট্রোবাংলা। এই অংশের ২.৮১ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১১৮ থেকে ৩৭০ মিটার গভীরতায় সাড়ে ১৩ কোটি টন কয়লার মজুদ রয়েছে।
অন্যদিকে, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জেটিবি বড়পুকুরিয়া খনির দক্ষিণ অংশ থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন সম্ভব বলে সুপারিশ করেছে। তবে পেট্রোবাংলা রুম এন্ড পিলার পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করতে মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব দিয়েছে।
২০২৭ সাল পর্যন্ত বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা উত্তোলনের কাজ পেয়েছে চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এক্সএমসি-সিএমসি কনসোর্টিয়াম।
এই কনসোর্টিয়াম জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে জানিয়েছে, চলমান চুক্তির মেয়াদ বাড়ালে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির মধ্যভাগ থেকে চুক্তির লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত ১০ লাখ ৮০ হাজার টন কয়লা উত্তোলন সম্ভব হবে।
২০০৫ সালে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করে ফুলবাড়ি কয়লাখনি থেকে ওপেন পিট বা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের সুপারিশ করেছিল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তবে স্থানীয় জনগণের আন্দোলনের মুখে কয়লা উত্তোলন কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এ খনি থেকে রুম এন্ড পিলার বা রুম এন্ড পিলার উইথ স্টোয়িং পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা যাবে কি-না, সে বিষয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করার সুপারিশ করেছে পেট্রোবাংলা।
ভূগর্ভস্থ মজুদের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় কয়লাখনি জামালগঞ্জের ৬৪০ থেকে ১,১৫৮ মিটার গভীরতায় মজুদের পরিমাণ প্রায় ৫৪৫ কোটি (৫,৪৫০ মিলিয়ন) টন। ২০১৬ সালে পরিচালিত এক সমীক্ষায় এই খনির উত্তর-পশ্চিম অংশের ১৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ৬০০ থেকে ৮০০ মিটার গভীরতায় ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের সুপারিশ করে জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
এক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, উত্তর-পশ্চিম অংশ থেকে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা (প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি) করা যেতে পারে। এছাড়া, আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় কি-না, সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ফিজিবিলিটি স্টাডি করা প্রয়োজন।
এছাড়া, ১২.২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে খালাশপীর কয়লাক্ষেত্রে ২২২ থেকে ৫১৬ মিটার গভীরতায় মজুদের পরিমাণ সাড়ে ৬৮ কোটি টন। হোসাফ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এবং শ্যানডং-লুডি জিনওয়েন মাইনিং গ্রুপ কনসোর্টিয়াম ২০০৫-০৬ সালে সালে যৌথভাবে ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করে লংওয়াল মাইনিং পদ্ধতি অনুসরণের সুপারিশ করে।