উত্তরাধিকার-দ্বন্দ্বে নাসির গ্রুপের উত্তরসূরিরা
কুষ্টিয়ার এক কৃষকের ছেলে নাসির উদ্দিন বিশ্বাস তার শিল্প সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে জীবনের পাঁচ দশকেরও বেশি সময় উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু কপর্দকহীন থেকে ধনকুবের হওয়ার এ গল্পে এখন যেন ট্র্যাজেডির ছায়া। তার মৃত্যুর দুই বছরেরও কম সময়ে দেশের কাচ শিল্পের অগ্রগামী এ শিল্প-পরিবারটি এখন বিভক্ত হয়ে গেছে। নাসির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ-এর নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিবারে দুটি পক্ষের মধ্যে চলছে আইনি লড়াই।
এ বিরোধ আবর্তিত হচ্ছে গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতার দুই স্ত্রী এবং তাদের সন্তানদের ঘিরে। দুপক্ষই ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত এ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে।
পরিবারের এক পক্ষ — নাসিরের দ্বিতীয় স্ত্রী তাসলিমা সুলতানা, তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে কোম্পানির উত্তরাধিকার পেতে হাইকোর্টে দুই ডজনেরও বেশি মামলা দায়ের করেছেন। যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) সূত্রে জানা গেছে, গ্রুপের ১২টি কোম্পানির মধ্যে ৮টির ওপর তারা সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছেন।
অন্য দুটি কোম্পানির একটি নাসির গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক ফ্লোট গ্লাস মার্কেটের ৬০–৬৫ শতাংশের অংশীদার। এটি এবং বিশ্বাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ এখনও নাসিরের প্রথম স্ত্রী আনোয়ারা বিশ্বাস, তার ছেলে ও দুই মেয়ের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ দুই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে আছেন আনোয়ারার মেয়ে নাসিমা বিশ্বাস।
এ বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় স্ত্রী আরেকটি কোম্পানি নাসির ওপাল গ্লাস অ্যান্ড ক্রোকারিজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নিয়ন্ত্রণ চেয়ে হাইকোর্টে দুটি মামলা দায়ের করেন। নাসিরের প্রথম স্ত্রী এবং তার সন্তানেরা বর্তমানে পরিচালক হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে নাসির ওপাল গ্লাস অ্যান্ড ক্রোকারিজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যাংক লেনদেনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন হাইকোর্ট।
প্রতিষ্ঠাতারা তাদের সারাজীবন ছোট্ট একটি ব্যবসাকে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে মারা যাওয়ার পর তাদের উত্তরসূরিদের উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্বের এরকম ঘটনা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আরও ঘটার নজির রয়েছে।
সর্বশেষ এ ধরনের বিরোধ দেখা গেছে ট্রান্সকম গ্রুপে। প্রতিষ্ঠাতা লতিফুর রহমানের মৃত্যুর পর সম্পদ বণ্টন নিয়ে গ্রুপটির দ্বিতীয় প্রজন্মের উত্তরাধিকারীরা নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন।
লতিফুর রহমানের দুই সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ শাযরেহ হক তার মা ও গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান শাহনাজ রহমান এবং বড় বোন ও বর্তমান সিইও সিমিন রহমানের বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গ, জালিয়াতি ও দলিল জালের মাধ্যমে শাযরেহ ও তার প্রয়াত ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে পারিবারিক সম্পত্তির — যার মূল্য দাবি করা হয় ১০ হাজার কোটি টাকা — ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগে একাধিক মামলা দায়ের করেন।
এখন নাসির গ্রুপ-এর ক্ষেত্রেও একই ধরনের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। নাসির গ্রুপের সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নাসির উদ্দিন বিশ্বাস ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মারা যাওয়ার পর দুই স্ত্রী ও তাদের সন্তানদের বিরোধের কারণে কোম্পানির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ গ্লাস মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন আলমগীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'নাসির গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এখনও ফ্লোট গ্লাসের বাজারে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।'
'আগে ফ্লোট গ্লাসের বাজারে নাসির গ্লাসের মার্কেট শেয়ার ছিল ৬০–৬৫ শতাংশ। তবে পিএইচপি এবং এবি গ্লাস সফলভাবে বাজারের একটি বড় অংশ দখল করে নিয়েছে,' নাসির উদ্দিনের কৌশল ধরে রাখতে ও প্রতিযোগীদের থেকে এগিয়ে থাকতে গ্রুপটির বর্তমান প্রজন্মের ব্যর্থতার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন।
বিজিএমএ সভাপতি বলেন, 'একটি কার্যকর বাজার-ভিত্তিক কৌশল না থাকলে এখন মনে হচ্ছে যে পিএইচপি-এর মতো অন্যান্য কোম্পানিগুলো আগামী বছরগুলোতে সুবিধা পেতে পারে। কারণ নাসির গ্রুপের ডিলার বা এজেন্টদের সঙ্গে আগের সেই ব্যবসায়িক পদ্ধতি আর ধরে রাখা হয়নি।'
নাসির গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানি ফ্লোট গ্লাস, মেলামাইন পণ্য, মুদ্রণ ও প্যাকেজিং সামগ্রী, তামাক, ফুটওয়্যার, গ্লাসওয়্যার, টিউব, ও এনার্জি-সেভিং বাতিসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করে। এসব পণ্য দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় বাজারে বিক্রি হয়।
২০২২ সাল পর্যন্ত এ গ্রুপের কোম্পানিগুলোর বার্ষিক টার্নওভার ছিল প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।
নাসির গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নাসির গ্রুপের ফ্ল্যাগশিপ কোম্পানি হিসেবে বিবেচিত হয়। কোম্পানির ওয়েবসাইট অনুসারে, এটি বার্ষিক প্রায় এক লাখ টন ফ্লোট গ্লাস উৎপাদন করে দেশে শীর্ষস্থানে রয়েছে।
দ্বিতীয় স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ন্ত্রিত কোম্পানি
নাসির গ্রুপের ৮টি কোম্পানি বর্তমানে নাসিরের দ্বিতীয় স্ত্রী এবং তার সন্তানেরা নিয়ন্ত্রণ করেছন। এগুলো হলো বাংলাদেশ মেলামাইন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, নাসির এনার্জি সেভিং ল্যাম্প ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বাংলাদেশ ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, নাসির গ্লাসওয়্যার অ্যান্ড টিউব ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, নাসির টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, নাসির লিফ টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, নাসির প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও নাসির বিড়ি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
নাসির উদ্দিনের দ্বিতীয় স্ত্রী তাসলিমা সুলতানা এসব কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর তার ছেলে মামুন বিশ্বাস চেয়ারম্যানের পদে আছেন।
গত তিন বছরে তসলিমা ও তার তিন সন্তান এসব কোম্পানির মালিকানার দাবিতে হাইকোর্টে ২৫টি মামলা করেছেন। আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানিগুলোর তদারকির জন্য একজন স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ করা হয়। পরবর্তীকালে এ স্বাধীন পরিচালক কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা এবং পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ করেন।
মামলার নথি অনুসারে, দ্বিতীয় স্ত্রী এবং সন্তানেরা অভিযোগ করেছেন, নাসিরের মৃত্যুর পর তার প্রথম স্ত্রী এবং তার সন্তানেরা বেআইনিভাবে গ্রুপটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। তারা নাসির উদ্দিনের সমস্ত শেয়ার দখল করে দ্বিতীয় পক্ষকে তাদের 'ন্যায্য মালিকানা' থেকে বঞ্চিত করেছেন।
আইনজীবীরা বলেছেন, দ্বিতীয় পক্ষ তাদের 'আইনগত অধিকার' পাওয়ার জন্য আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নাসির গ্রুপের একটি কোম্পানির একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'নাসির গ্লাস দেশের ফ্লোট গ্লাসের শীর্ষস্থানীয় উৎপাদনকারী। তবে চেয়ারম্যানের মৃত্যুর পর ব্যবসায় কিছুটা মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। এখন অন্যান্য কোম্পানি বাজারে ভালো অবস্থানে আসছে।'
'এ রকম প্রতিটি কোম্পানির উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বেশ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। নাসির উদ্দিন জীবিত থাকাকালীন যেভাবে ব্যবসার প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল, সেটি আর নেই। পাশাপাশি বার্ষিক টার্নওভারও কমেছে,' তিনি আরও বলেন।
বারিধারায় ২ কার্যালয়
উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্বের অনুসন্ধানে টিবিএস-এর প্রতিবেদকদেরা ১৮ মার্চ রাজধানীর বারিধারায় ৮৫ সোহরাওয়ার্দী অ্যাভিনিউতে অবস্থিত নাসির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান কার্যালয়ে যান।
সেখানর একজন নিরাপত্তাপ্রহরী বলেন, 'এ অফিসে নাসির উদ্দিনের ২য় স্ত্রী তাসলিমা সুলতানা ও তার তিন সন্তান বসেন। কিন্তু তাদের কেউ আজ অফিসে নেই।'
ওই প্রহরী আরও জানান, বারিধারায় ৯ নম্বর সড়কের ১৬ নম্বর বাড়িতে গ্রুপটির আরেকটি প্রধান কার্যালয় রয়েছে, যেখানে নাসিরের প্রথম স্ত্রী আনোয়ারা বিশ্বাস এবং তার সন্তান নাসিমা বিশ্বাস, নাসিম বিশ্বাস এবং নাসরিন রুবি বিশ্বাস বসেন।
তবে সেখানে গিয়েও কাউকে পাননি টিবিএস-এর প্রতিনিধিরা।
এরপর টিবিএস প্রতিবেদকেরা নাসিরের দ্বিতীয় স্ত্রী তাসলিমা সুলতানার বারিধারার বাসায় যান। তবে পরিবারের কোনো সদস্য কথা বলতে রাজি হননি।
'তাসলিমা মাড্যাম ও মামুন স্যার বিশ্রাম করছেন। তারা আপনাদেরকে সিসি ক্যামেরায় দেখেছেন। তারা আপনদের সঙ্গে পরে কথা বলবেন, এখন নয়,' বলেন বাড়ির নিরাপত্তাপ্রহরী ইদ্রিস।
তসলিমা সুলতানার আইনজীবী শাহনাজ আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি টিবিএসকে বলেন, 'বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয়। তাই আইনজীবী হিসেবে এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেওয়া বা মন্তব্য করতে পারব না।'
দুই ডজন মামলা
হাইকোর্টের মামলার দৈনন্দিন কার্যতালিকা অনুসন্ধান করে নাসির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের বিভিন্ন কোম্পানি নিয়ে মোট ২৫টি মামলার কথা জানা যায়। এসব মামলা করেছেন তসলিমা সুলতানা ও তার তিন সন্তান।
এ ছাড়াও তাদের দায়ের করা আরও ৭টি মামলা নিম্ন আদালত বিচারাধীন রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
হাইকোর্ট সূত্র জানায়, তাসলিমা সুলতানা নাসির গ্লাসওয়্যার অ্যান্ড টিউব ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং এর পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে মোট ছয়টি মামলা দায়ের করেছিলেন, যার বেশিরভাগই এখন নিষ্পত্তি হয়েছে।
এ ছাড়া তিনি নাসির টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মালিকানা নিয়ে হাইকোর্টে তিনটি মামলা, বাংলাদেশ মেলামাইন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মালিকানা দাবিতে তিনটি মামলা এবং বাংলাদেশ ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মালিকানা নিয়ে চারটি মামলা করেছেন।
এদিকে তাসলিমা সুলতানা এবং তার তিন সন্তান নাসির এনার্জি সেভিং ল্যাম্প ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মালিকানা পেতে চারটি মামলা এবং নাসির ওপাল গ্লাস অ্যান্ড ক্রোকারিজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ফিরে পেতে দুটি মামলা দায়ের করেছেন।
দেশীয় অনেক শিল্পের পথিকৃৎ নাসির উদ্দিন
নাসির উদ্দিন বিশ্বাস বাংলাদেশে বেশকিছু যুগান্তকারী শিল্পের পথপ্রদর্শক। ১৯৮২ সালে তিনি দেশের প্রথম স্পোর্টস শ্যুর কারখানা স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশের প্রথম মেলামাইন শিল্পের সূচনা করেন। তারপর একে একে ফ্লোট গ্লাস, এনার্জি সেভিং বাল্ব এবং কাচের তৈজসপত্রের কারখানা স্থাপিত হয় তার হাত ধরে।
কুষ্টিয়ার একটি ছোট কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া নাসির ১৯৭৫ সালে প্রাথমিকভাবে আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আকিজ উদ্দিনের সহায়তায় ঢাকা টোব্যাকো কোম্পানিতে তামাক সরবরাহের মাধ্যমে তার ব্যবসায়িক যাত্রা শুরু করেন। তবে তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্কে চিড় ধরলে এ ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৭৭ সালে নাসির উদ্দিন কুষ্টিয়ায় নর্থ বেঙ্গল প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা করেন। তারপরে ঢাকায় স্পোর্টস শ্যু কারখানা স্থাপন করেন।
নিরলস প্রচেষ্টা ও দূরদৃষ্টির মাধ্যমে নাসির উদ্দিন বিশ্বাস দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ ব্যবসায়ীতে পরিণত হন।