ভারতীয় এইচ-এনার্জি থেকে পাইপলাইনে এলএনজি আমদানির চুক্তি চূড়ান্তের পর্যায়ে পেট্রোবাংলা
চার বছর ধরে আলোচনার পর পেট্রোবাংলা [বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশন] আন্তঃসীমান্ত প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারতীয় একটি বেসরকারি কোম্পানির কাছ থেকে রূপান্তরিত এলএনজি আমদানির বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের কাছাকাছি পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
দেশে ক্রমবর্ধমান গ্যাস সংকট কমানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পেট্রোবাংলা মুম্বাইভিত্তিক এইচ-এনার্জি প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে যাচ্ছে।
পাইপলাইন স্থাপন এবং এলএনজি [তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস] সরবরাহ সংক্রান্ত দুটি চুক্তি আগামী অর্থবছরের প্রথমার্ধে স্বাক্ষরিত হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
'এইচ-এনার্জির সঙ্গে আলোচনা শেষ পর্যায়ে। মাত্র তিন–চারটি পয়েন্ট বাদে অন্য সব বিষয়ে উভয়পক্ষ একমত হয়েছে। অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে জ্বালানি বিভাগের মতামত চাওয়া হয়েছে। মতামত পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে,' ১৭ এপ্রিল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার।
চুক্তি স্বাক্ষরের দুই বছরের মধ্যে কোম্পানিটি এলএনজি সরবরাহ করবে বলে জানান তিনি।
পেট্রোবাংলা রূপান্তরিত [রিগ্যাসিফাইড] এলএনজি দীর্ঘমেয়াদে আমদানির জন্য ২০২১ সালের ১৬ জুন এইচ-এনার্জির সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি একই উদ্দেশ্যে ২০১৭ সালে ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন লিমিটেডের সঙ্গে প্রথম এমওইউ স্বাক্ষর করেছিল।
পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, এইচ-এনার্জি থেকে বছরে ০.৮ থেকে ১০ মিলিয়ন মেট্রিক টন এলএনজি আমদানির জন্য আলোচনা চলছে।
কোম্পানিটি থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস আমদানি, গ্যাসের ব্যবহার, অর্থনৈতিক সুবিধা-ক্ষতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সম্ভাব্য সব দিক পর্যালোচনা করা হয়েছে বলে জানান তারা।
কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমানে পাইপলাইন স্থাপন ও ব্যবস্থাপনার জন্য ভারতীয় কোম্পানিটির দেওয়া অর্থ পরিশোধ পদ্ধতি, এলএনজির দাম ইত্যাদির নিয়ে আলোচনা চলছে।
এগুলো চূড়ান্ত হলে বিষয়টি চুক্তির পর্যায়ে যাবে বলে তারা জানান।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মো. নূরুল আলম ১৮ এপ্রিল টিবিএসকে বলেন, 'আমি জানতে পেরেছি, এইচ-এনার্জির সঙ্গে আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে।'
গ্যাস পাবে পশ্চিমাঞ্চল
পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা জানান, ভারত থেকে গ্যাস পরিবহনের জন্য সাতক্ষীরা থেকে খুলনা পর্যন্ত ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ৬৫ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। তিনি বলেন, পাইপলাইনের মাধ্যমে দৈনিক ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
খুলনার চলমান ও ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রসমূহে গ্যাস সরবরাহ করা হবে এবং এভাবে দেশের পশ্চিমাঞ্চল প্রথমবারের মতো গ্যাস পাবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
বিবিসির একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এইচ-এনার্জি মহারাষ্ট্রের জয়গড় বন্দরে ভারতের প্রথম ভাসমান স্টোরেজ এবং রিগ্যাসিফিকেশন টার্মিনাল নির্মাণ করেছে। কোম্পানিটি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় একটি এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের জন্য কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের সঙ্গে একটি এমওইউ স্বাক্ষর করেছে। ওই টার্মিনাল থেকে বাংলাদেশে এলএনজি পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে এটি।
চাহিদা ও সরবরাহ
পেট্রোবাংলার ১৮ এপ্রিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে গ্যাসের প্রাপ্যতা ছিল প্রতিদিন দুই হাজার ১৩৩ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি)। এর মধ্যে স্থানীয় কূপগুলো থেকে পাওয়া গেছে এক হাজার ১৩৫ এমএমসিএফডি এবং আমদানি করা গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে ৯৯৮ এমএমসিএফডি।
দুই হাজার ৩১৭ এমএমসিএফডি গ্যাস-চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পেয়েছে এক হাজার ৩২৯ দশমিক ৬ এমএমসিএফডি গ্যাস এবং সার কারখানাগুলোকে দেওয়া হয়েছে ২৩ দশমিক ২ এমএমসিএফডি গ্যাস।
বাড়ছে গ্যাস আমদানি
পেট্রোবাংলার নথি অনুযায়ী, সরকার গত বছর ৩টি এলএনজি বিক্রি ও ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ২০২৬ সাল থেকে শুরু করে ১৫ বছরের জন্য বার্ষিক দেড় মিলিয়ন মেট্রিক টন এলএনজি আমদানির জন্য কাতার এনার্জি ট্রেডিং এলএলসি'র সঙ্গে গত বছরের ৩০ মে প্রথম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
২০২৬ সাল থেকে প্রতি বছর বিদ্যমান চুক্তির অতিরিক্ত শূন্য দশমিক ২৫ থেকে দেড় মিলিয়ন মেট্রিক টন এলএনজি আমদানির লক্ষ্যে দ্বিতীয় চুক্তিটি গত বছরের ১৯ জুন কাতারের ওকিউ ট্রেডিং লিমিটেডের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয়।
গত বছরের ৮ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক্সেলরেট এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেডের সঙ্গে ১৫ বছরের জন্য বার্ষিক ১০ লাখ মেট্রিক টন এলএনজি আমদানির তৃতীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পেট্রোবাংলা সামিট অয়েল অ্যান্ড শিপিং কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গেও একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যার অধীনে কোম্পানিটি ২০২৬ থেকে ১৫ বছর মেয়াদে এলএনজি সরবরাহ করবে।
এগুলোর পাশাপাশি মালয়েশিয়ার পেরিন্টিস আকাল এসডিএন বিএইচডি থেকে এক বছরের জন্য বার্ষিক এক মিলিয়ন মেট্রিক টন এলএনজি আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে। লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ এবং সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি চুক্তিটি অনুমোদন করেছে। খুব শিগগিরই চুক্তি স্বাক্ষর হবে।
চলতি বছর এলএনজি সরবরাহ শুরু করবে কোম্পানিটি। আগামী দুই বছরে গানভর সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড থেকে ২৪টি এলএনজি কার্গো কেনার বিষয়েও আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, দেশে গ্যাসের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির পাশাপাশি স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি সংগ্রহ বাড়ানো হচ্ছে বলে জানান তারা।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে প্রায় ৫৪ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হয়েছিল। এ ছাড়া কাতার থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে বলে জানান তারা।
কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমানে গ্যাসের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি সংগ্রহের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর সৃষ্ট চাপ কমাবে পাইপলাইনে গ্যাস আমদানির পদক্ষেপ।