চট্টগ্রাম বন্দরে ৬ লাইটার জেটি: কমবে পণ্য পরিবহন ব্যয়, সময় ও নগরের যানজট
চট্টগ্রাম বন্দরে বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজে আসা পণ্য খালাসে নির্মাণ করা হচ্ছে ছয়টি লাইটার জেটি। এ লক্ষ্যে কর্ণফুলী নদীর তীরে পতেঙ্গার লালদিয়ার চর এলাকায় ইতোমধ্যে ইয়ার্ড নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে।
এই জেটিগুলোর কার্যক্রম শুরু হলে পণ্য খালাসে এক-তৃতীয়াংশ সময় কমে আসবে। কমে যাবে পণ্য পরিবহন ব্যয়ও। একইসঙ্গে, চট্টগ্রাম নগরীর যানজটও কমে আসবে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং বন্দর ব্যবহারকারীরা।
এর আগে, ২০১৮ সালের কর্ণফুলী নদীর সদরঘাট এলাকায় পাঁচটি লাইটার জেটি নির্মাণ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। নতুন ছয়টি চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরের লাইটার জেটির সংখ্যা হবে ১১টি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, "লালদিয়ার চরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ইয়ার্ড নির্মাণ করে দিয়েছে। লাইটার জেটি পরিচালনার জন্য ছয়টি প্রতিষ্ঠানও চুড়ান্ত হয়েছে। লিজ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো পন্টুন জেটির কাজসম্পন্ন করবে। শীঘ্রই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তি করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।"
"আগামী ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে অপারেশনে যাবে লালদিয়া লাইটার জেটি," যোগ করেন তিনি।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, লালদিয়ায় লাইটার জেটির জন্য ৬টি ব্লক নির্ধারণ করেছ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ১ নম্বর ব্লকের জন্য ৬ কোটি ৫ হাজার টাকায় ওমেরা ফুয়েলস লিমিটেড, ২ নম্বর ব্লকের জন্য ৬ কোটি ৮ হাজার টাকায় ইস্ট কোস্ট ট্রেডিং (প্রা.) লিমিটেড, ব্লক নম্বর-৩-এর জন্য ৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকায় এসএস ট্রেডিং, ব্লক-৪-এর জন্য ৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকায় শাহ সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ, ৭ কোটি ১৩ লাখ টাকায় ব্লক-৫-এর জন্যে জিপিএইচ ইস্পাত এবং এবং ৭ কোটি ১৩ লাখ টাকায় ব্লক-৬-এর জন্য এন মোহাম্মদ ট্রেডিং করপোরেশনকে মনোনীত করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে টাকাও পরিশোধ করেছে।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সাথে ১০ বছরের জন্য চুক্তি করতে যাচ্ছে বন্দর। প্রতি বছর একই হারে ভাড়া পরিশোধ করবে প্রতিষ্ঠানগুলো। ইয়ার্ড ভাড়া দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বছরে প্রায় ৪০ কোটি টাকা আয় করবে।
লালদিয়ায় দুটি লাইটার জেটি বরাদ্দ পাওয়া প্রতিষ্ঠান এমজেএল গ্রুপের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে টিবিএসকে বলেন, "লালদিয়া জেটিতে এমজেএল গ্রুপ লিকুইড বাল্ক কার্গো যেমন– গ্যাস , তেল খালাস করবে। জেটি বরাদ্দ পাওয়ার পরও আমরা পন্টুন জেটিসহ অন্যান্য মালামাল সংযোজনের কাজ শীঘ্রই শুরু করবো। নতুন লাইটার জেটি নির্মাণের ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য খালাস কার্যক্রম আরো গতি পাবে।"
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের তথ্য মতে, আকার ভেদে ১,২০০ মেট্রিক টন থেকে ৫ হাজার মেট্রিক টন পণ্য বহন করে লাইটার জাহাজ। প্রতিটি জাহাজ ৫,০০০ মেট্রিক টন হিসেবে ছয়টি লাইটার জেটিতে একসাথে ৩০,০০০ মেট্রিক টন পণ্য খালাস করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন জাহাজ মালিকরা।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ টিবিএসকে বলেন, "মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজ যোগে পণ্য খালাসের জন্য কর্ণফুলী নদীর তীরে অন্তত ২০টি লাইটার জেটি প্রয়োজন। এখন বন্দর কর্তৃপক্ষ ছয়টি আধুনিক লাইটার জেটি করছে এটি ইতিবাচক একটি উদ্যোগ। কর্ণফুলী নদীর তীরে আরো লাইটার জেটির প্রয়োজন। এর সুফল ভোগ করবে ব্যবসায়ী এবং ভোক্তারা।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে প্রায় ৪,২০০ বাণিজ্যিক জাহাজ আসে। এসব জাহাজের ৪৫ শতাংশ খোলা পণ্যবাহী বা বাল্ক ক্যারিয়ার। ৪৫ শতাংশ কন্টেইনারবাহী এবং ১০ শতাংশ লিকুইড কার্গোবাহী জাহাজ।
কমবে সময় ও যানজট
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, কর্ণফুলী নদীর মোহনা থেকে সদরঘাটের লাইটার জেটি এবং ঘাটে পণ্য খালাস করতে একটি লাইটার জাহাজকে ১৬-১৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু লালদিয়া লাইটার জেটিতে পৌঁছাতে পাড়ি দিতে হবে ৭ কিলোমিটার।
সদরঘাটের লাইটার জেটি ঘাটে ৫,০০০ টন সক্ষমতার জাহাজে পণ্য খালাস করতে লাগে চার থেকে পাঁচ দিন। লালদিয়া জেটিতে সময় লাগবে এক থেকে সর্বোচ্চ দুই দিন।
এছাড়া, পণ্য নিতে আসা যানবাহনগুলোর পার্কিংয়ের জন্য প্রতিটি জেটিগুলোর জন্য দুই একর করে জায়গা বরাদ্দ রেখেছে বন্দর।
চট্টগ্রামের আমদানিকারকরা লাইটার জাহাজযোগে কর্ণফুলী নদীর তীদের বিভিন্ন ঘাটে এনে পণ্য খালাস করেন। ঘাটগুলোর অবস্থান চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরে হওয়ায় প্রতিদিন কয়েক হাজার ট্রাক, কাভার্ভভ্যান চলাচল করে। বাংলাবাজার লাইটার জেটি, ঘাট থেকে পণ্য লোড-আনলোড করতে আসা ট্রাকগুলো চট্টগ্রাম শহরের রুটগুলো ব্যবহার করায় যানজট লেগে যায়।
লালদিয়ায় পণ্য লোডিং করে দক্ষিণ চট্টগ্রামের গাড়িগুলো টানেল হয়ে আনোয়ারা প্রান্তে চলে যাবে। এছাড়া, ঢাকামুখী যান চট্টগ্রামের আউটার রিংরোড হয়ে ফৌজদার হাট দিয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলে যাবে। এর ফলে চট্টগ্রাম শহর এড়িয়ে যানবাহনগুলো গন্তব্যে চলে যেতে পারবে।
২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সদরঘাট এলাকায় ৫টি লাইটার জেটি নির্মাণ করে। এসব জেটি বিএসআরএম গ্রুপ, কেএসআরএম গ্রুপ, আবুল খায়ের স্টিল, কনফিডেন্স সিমেন্ট গ্রুপ এবং বিএসএম গ্রুপকে বরাদ্দ দেয় বন্দর।
শিল্প গ্রুপগুলো তাদের আমদানি করা পণ্য বহির্নোঙ্গরে মাদার ভেসেল থেকে লোড করে এই জেটিগুলোতে পুনরায় খালাস করে। সেখান থেকে সড়ক পথে পরিবহন করে কারখানায় এবং গুদামে নিয়ে যায় পণ্যগুলো।