চট্টগ্রাম বন্দরে শিপমেন্ট হয়নি ৫ হাজার কন্টেইনার, ৬৮ জাহাজের ডেমারেজ চার্জ ১৩ লাখ ডলার
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে চট্টগ্রাম বন্দর জেটি এবং বহির্নোঙরে জাহাজে পণ্য ওঠানো-নামানো কার্যক্রম বন্ধ ছিল অন্তত ৬০ ঘণ্টা বা আড়াই দিন। এই সময়ে কন্টেইনার ডেলিভারিসহ বন্দরের অন্যান্য প্রায় সব কার্যক্রমই বন্ধ ছিল। ফলে চট্টগ্রামের ১৯টি আইসিডিতে প্রায় পাঁচ হাজার টিইইউ রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার শিপমেন্ট আটকা পড়ে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই তৈরি পোশাকের চালান। রপ্তানি পণ্যগুলো এখন সময়মতো ক্রেতার হাতে পৌঁছাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
শুধু তাই নয়, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বন্দরের জেটি এবং বহির্নোঙরে পণ্য খালাসরত ৬৮টি জাহাজের কার্যক্রম বন্ধ করে গভীর সাগরে ফেরত পাঠানো হয়। প্রায় ৬০ ঘণ্টা কাজ না হলেও এই ৬৮টি জাহাজে অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হবে অন্তত ১৩ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই অতিরিক্ত ভাড়ার প্রভাব শেষ পর্যন্ত পণ্যের মূল্যের ওপর পড়বে।
প্রতিটি জাহাজে গড়ে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন পণ্য হিসেবে ৬৮টি জাহাজে প্রায় ২৪ লাখ মেট্রিক টন পণ্য রয়েছে বলে জানিয়েছে শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে ভোগ্য পণ্য, ভোজ্য তেল, শিল্পের কাঁচামাল সহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ঘূর্ণিঝড়ের কারণে অবশ্যই বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। জাহাজে পণ্য ওঠানো-নামানো আড়াই দিন বন্ধের প্রভাবে জাহাজ এবং কন্টেইনার জটের মুখে পড়বে। জাহাজের ভাড়া বাবদ অতিরিক্ত অর্থ আমদানিকারকদেরই পরিশোধ করতে হবে। এতে বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে আবহাওয়া অধিদপ্তর ৯ নম্বর মহাবিপৎসংকেত ঘোষণার পর গত শনিবার (২৫ নভেম্বর) রাত থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। শনিবার রাতে বহির্নোঙরে পণ্য খালাস কার্যক্রম বন্ধ করে ৪৯টি মাদার ভেসেল গভীর সাগরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বন্দর জেটিতে থাকা ১৯টি জাহাজ রবিবার সকালের জোয়ারে গভীর সাগরে পাঠায় বন্দর।
পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে মঙ্গলবার সকালে জেটিতে জাহাজ ভেড়ানো হয়। গভীর সাগরে থেকে মাদার ভেসেলে ফেরত আনার পর বহির্নোঙরে পণ্য খালাস কার্যক্রম মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়।
সে হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের কার্যক্রম বন্ধ ছিল আড়াই দিন বা ৬০ ঘণ্টা। পণ্য খালাস কার্যক্রম পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে প্রায় ৩ দিন সময় লেগে যায়।
শিপিং এজেন্টদের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে যেসব ফিডার ভেসেল পণ্য খালাস করে, সেসব জাহাজের দৈনিক চার্টার চার্জ (ভাড়া) গড়ে প্রায় ২০ হাজার ডলার। ১৯টি জাহাজের আড়াই দিন অতিরিক্ত সময় থাকার কারণে প্রতিটি জাহাজকে অন্তত ৫০ হাজার ডলার অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হবে। সে হিসাবে ১৯টি জাহাজের মোট অতিরিক্ত ভাড়ার পরিমাণ সাড়ে ৯ লাখ ডলার।
বহির্নোঙরে ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার মেট্রিক টন পণ্য ধারণ সক্ষমতার মাদার ভেসেল অবস্থান করে। এসব জাহাজের প্রতিটির ভাড়া গড়ে ৩০ হাজার ডলার। আড়াই দিন পণ্য খালাস কার্যক্রম বন্ধ থাকায় প্রতিটি জাহাজকে অন্তত ৭৫ হাজার ডলার অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হবে। সে হিসেবে ৪৯ টি মাদার ভেসেলের মোট অতিরিক্ত ভাড়ার পরিমাণ তিন লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ ডলার।
ডেলিভারি হয়নি ৭ হাজার কন্টেইনার
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রতিদিন স্বাভাবিক সময়ে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার কন্টেইনার ডেলিভারি হয়। ঝড়ের কারণে দুই দিনে অন্তত ৭ হাজার কন্টেইনার ডেলিভারি দেওয়া যায়নি।
আমদানিকারকরা জানিয়েছন, জাহাজ থেকে কন্টেইনার নামানোর পর ইয়ার্ডে চারদিন ফ্রি রাখার সুযোগ পান আমদানিকারকরা। এরপর বিভিন্ন মেয়াদে পোর্ট এবং শিপিং ডিউজ দিতে হয় আমদানিকারকদের।
বৈরী আবহাওয়ার কারণে কন্টেইনার ডেলিভারি না নিতে পারলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেমারেজ (ক্ষতিপূরণ মাশুল) মওকুফের বিধান নেই বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম সিএএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু টিবিএসকে বলেন, 'বৈরী আবহাওয়ার কারণে আমরা বন্দর থেকে দুই দিন পণ্য ডেলিভারি নিতে পারিনি। এতে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি রয়েছে। এই ক্ষতির প্রভাব পড়বে আমদানি পণ্যের মূল্যের ওপর।
শিপমেন্ট হয়নি ৫ হাজার রপ্তানি কন্টেইনার
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি হওয়া শতভাগ পণ্য কন্টেইনার বোঝাই হয় চট্টগ্রামের ১৯টি বেসরকারি আইসিডি (ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো) থেকে। বন্দরে জাহাজ না থাকায় গত রবিবার ও সোমবার অন্তত ৫ হাজার টিইউ রপ্তানি কন্টেইনার পাঠানো যায়নি।
সামিট গ্রুপের পরিচালনাধীন তিনটি কন্টেইনার ডিপো ওসিএল, এসএপিএল, ইস্পাহানি সামিট এলায়েন্স পোর্ট থেকে গত তিন দিনে প্রায় ৬০০ টিইউ রপ্তানি কন্টেইনার বন্দরে পাঠানো সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন ডিপো তিনটির কর্তৃপক্ষ।
ডিপো মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোট অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইসিডিএ) পরিচালক ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম মজুমদার টিবিএসকে বলেন, মঙ্গলবার থেকে ডিপো থেকে বন্দরে কন্টেইনার আনা-নেওয়া শুরু হয়েছে।
বিজিএমইএ'র ভাইস প্রেসিডেন্ট রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, 'সময়মতো ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে কন্টেইনার না পৌঁছানোর কারণে ক্রেতার কাছে পণ্য চালান সময়মতো পৌঁছানো অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।'
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, 'আজ থেকে কন্টেইনার ডেলিভারি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বন্দরে জেটিতে জাহাজ ফেরত আনার পর শুরু হয়েছে কন্টেইনার ওঠানো-নামানো।'