৬৪ বছরের পুরোনো ‘মেয়াদোর্ত্তীর্ণ’ বাঁধ ভেঙে চোখের পলকে হারিয়ে যায় তাদের বসতি
'সারারাত ঝড়ের সময় আমরা ঘরের খুঁটি ধরে বসে ছিলাম। সকালে বেরিয়ে দেখি, প্রচণ্ডবেগে বাড়ির দিকে পানি ছুটে আসছে। কিছু বোঝার আগে সবকিছু চোখের পলকে হারিয়ে গেল। দ্রুত কিছু মালামাল নিয়ে নৌকায় উঠে রাস্তায় চলে আসি। পরে গিয়ে দেখি ঘরে আর কিছু নাই।'
বুধবার (২৯ মে) অশ্রুসিক্ত নয়নে কথাগুলো বলছিলেন খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়ের গোপীপাগলা গ্রামের দিপালী সরদার (৩২)। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সৃষ্ট প্লাবনে বসতঘর হারিয়েছেন এ নারী।
'বাড়িটা এখন বুকসমান পানির নিচে। ঘরের ড্রামে থাকা চাল পর্যন্ত পানিতে ভেসে গেছে। ৬০টি হাঁস-মুরগি ও ৫টি গরুর খোঁজ মিলছে না,' বলেন তিনি।
অসহায় অবস্থায় তার মতো গ্রামের অনেকে এখন সড়কের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন। ২৬ মে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আঘাত হানে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল। এটির প্রভাব থাকে সোমবার পর্যন্ত। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে অনেক নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় লোকালয়।
দিপালী সরদারদের চিংড়ির ঘের ভেসে গেছে জলোচ্ছ্বাসের ফলে সৃষ্ট প্লাবনের পানিতে। গত দুদিন ধরে তার পরিবারের সদস্যরা মুড়ি, চিড়া ও নদীর লবণাক্ত পানি খেয়ে বেঁচে আছেন।
'আমার সংসারে কোনো অভাব ছিল না। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে সবকিছু হারিয়ে গেল,' আক্ষেপের সুরে বলেন দিপালী সরদারের স্বামী প্রদীপ সরদার।
গোপীপাগলা গ্রামের পাশ্ববর্তী তেলিখালী গ্রামের পরিস্থিতি আরও করুণ। এ গ্রামের অন্যতম বড় গাজী বাড়িতে ২০টি বসতি রয়েছে। তার মধ্যে ১৫টি বাড়ি ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর প্লাবনের পানিতে ডুবে গেছে।
বাড়ির বাসিন্দা এনামুল গাজী বলেন, এত ভয়াবহ ক্ষতি তাদের আগে কোনোদিন হয়নি। 'এখন আমাদের বাড়ির বাসিন্দারা রাস্তায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। ৩টি পরিবার একেবারে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে।'
এ গ্রামগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২২ নং পোল্ডারের অন্তর্গত। রোববার ঝড়ের রাতে ওই পোল্ডারের তেলিখালি এলাকায় ভদ্রা নদীর বাঁধ প্রায় ৬০০ ফুট ভেঙে গিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে।
বাঁধ ভেঙে ভদ্রা নদীর পানিতে আশপাশের আরও ১১টি গ্রামের অধিংকাংশ বাড়ি প্লাবিত হয়েছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য সহকারী দীপিকা সরদার বলেন, পোল্ডারটির ১৩টি গ্রামে অন্তত ১০ হাজার মানুষের বসবাস।
গ্রামের মানুষেরা এখন খাবার পানির সংকটে ভুগছেন। অধিকাংশ মানুষের কাছে খাবার নেই জানিয়ে দীপিকা বলেন, 'গত দুদিন ধরে কেউ আমাদের গ্রামের খোঁজও নেয়নি। আজ [বুধবার] সরকারি পর্যায়ের কিছু লোক এসে সামান্য ত্রাণ বিতরণ করছেন।'
তবে পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহেরা নাজনীন বলেন, 'ওই এলাকার মানুষের মাঝে আমরা ইতোমধ্যে ত্রাণ পাঠিয়েছি। তবে ক্ষতির তুলনায় তা পর্যাপ্ত নয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আরও ত্রাণের আবেদন করা হয়েছে।'
৬৪ বছরের 'মেয়াদোর্ত্তীর্ণ' বাঁধ
বুধবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, তেলিখালির ভেঙে যাওয়া বাঁধের স্থানে এলাকার হাজারো নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে রিং বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করছেন।
বাঁধ মেরামতে অংশ নেওয়া আবতাব উদ্দীন বলেন, আমি তিন লাখ টাকা বিনিয়োগে লিজের পাঁচবিঘা জমিতে ঘের করেছিলাম। প্লাবনের কারণে একেবারে সব ধুয়ে-মুছে চলে গেছে।'
তার ঘেরে এখন আর কোনো মাছ নেই। 'তবু ঘেরটাকে তো টিকিয়ে রাখতে হবে। তাই সবার সঙ্গে স্বেচ্ছায় এসে বাঁধ মেরামতে অংশ নিয়েছি,' বলেন এ ভুক্তভোগী।
সেখানে থাকা মতিয়ার রহমান বলেন, 'পানি আটকাতে না পারলে আমাদের এলাকা রক্ষা করা যাবে না। প্রতিদিন জোয়ারের পানিতে বসতবাড়ির সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছে। না পেরে অসুস্থ শরীর নিয়ে বাঁধ মেরামত করতে এসেছি।'
টেকসহ বাঁধ নির্মাণ করা না হলে এ এলাকায় একই ধরনের ক্ষতি বারবার হবে বলে মন্তব্য করেন স্থানীয় খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামান।
'১৯৬০ সালের দিকে পাকিস্তান সরকার এ বাঁধ নির্মাণ করেছিল। এর মেয়াদ ছিল ২০ বছর। তবে দুঃখের বিষয় হলো, বিগত ৬৪ বছরের মধ্যে এ বাঁধ কখনো সংস্কার করা হয়নি,' বলেন তিনি।
'আমি নির্বাচিত হওয়ার পর এ এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি,' বলেন এ সংসদ সদস্য।