১০ হাজার মালয়েশিয়াগামী কর্মী ফ্লাইট মিস করতে পারেন যে কারণে
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সিন্ডিকেটের অব্যবস্থাপনা ও সন্দেহজনক লেনদেনের জন্য বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে কয়েক হাজার বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী কর্মীর মালয়েশিয়ায় যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অথচ মালয়েশিয়ার ঘোষণা অনুযায়ী, ৩১ মে, অর্থাৎ আজ শুক্রবারের পর আর কোনো নতুন বিদেশি কর্মী দেশটিতে প্রবেশ পারবেন না। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এই কর্মীরা।
খাতসংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে দেশটিতে যাওয়ার জন্য ফ্লাইটে ওঠার অপেক্ষায় আছেন এখনও ১০ হাজারেরও বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী। তাদের অনেকেই রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিলম্বের কারণে টিকিট কিনতে পারেননি।
ভুয়া চাহিদাপত্র ইস্যু করার ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। সম্ভাব্য নিয়োগকারীরা দুর্নীতির জন্য মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের কালো তালিকাভুক্ত হওয়ায় কিছু শ্রমিক আটকা পড়েছেন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ-এর (বায়রা) সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, গতকাল পর্যন্ত ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজারের মতো কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি।
১০০টি রিক্রুটিং এজেন্সি মিলে যে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে, তার অংশ শামীমের এজেন্সি সাদিয়া ইন্টারন্যাশনাল। কর্মীদের সমস্যা এবং ফ্লাইট না পাওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি।
এদিকে ঢাকা-মালয়েশিয়া রুটে বিমানভাড়া স্বাভাবিক দামের চেয়ে চারগুণ বেড়েছে। কর্মীদের এখন ১ লাখ টাকায় একটি টিকিট কিনতে হচ্ছে। অথচ ছয় মাসও একটি টিকিটের দাম ছিল ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা।
ঢাকার দোহারের বাসিন্দা আখিরুল ইসলাম বলেন, 'আমি অনেক আগে ভিসা পেয়েছি। কিন্তু রিক্রুটিং এজেন্সি যাওয়ার তারিখ জানাচ্ছিল না। তারপর হঠাৎ ২৩ মে শুনলাম, ৩১ তারিখের আগে ফিরতে হবে। খোঁজ নিয়ে দেখি ৪০ হাজার টাকার টিকিট নাকি ১ লাখ টাকা। দাম কমবে, এই আশায় অপেক্ষা করতে করতে আর টিকিট পেলাম না। এখন অন্য মাধ্যমে চেষ্টা করে যাচ্ছি।'
টিকিটের এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে অভিবাসন ব্যয় ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত উঠে গেছে। অথচ সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় ৭৯ হাজার টাকা।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী এম ফারুক খান গতকাল মালয়েশিয়ার যাত্রীদের জন্য বিমান ভাড়া নিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন।
তিনি বলেন, 'বিমান ভাড়ার বিষয়টা সরবরাহ ও চাহিদার ব্যাপার। যারা মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর সাথে জড়িত, তারা এক মাস আগেই জানত যে ৩১ মে শ্রমিক পাঠানোর শেষ তারিখ। কিন্তু এটা নিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সি বা অন্য সাপ্লায়াররা ব্যবস্থা নেয়নি। এখন বাংলাদেশ বিমান প্রতিদিন মালয়েশিয়ায় তিন থেকে চারটা করে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।'
মন্ত্রী আরও বলেন, 'গতকাল মালয়েশিয়ার কিছু লোক ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ায় এয়ার কম্বোডিয়ার একটা এয়ারক্রাফট দিয়ে একটি চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি চেয়েছে। গতকালকেই আমরা তাদের অনুমতি দিয়ে দিয়েছি। বিমান যদি আরও আগে জানত, তাহলে ব্যবস্থা নিতে পারত। বর্তমানে বিমানের হজ ফ্লাইট চলছে, তবু আমরা চেষ্টা করেছি সুযোগ দিতে।'
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যানুসারে, একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫ লাখ কর্মী নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মালয়েশিয়া। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ কর্মী ইতিমধ্যে চলতি বছরের এপ্রিলের মধ্যে দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছেন।
তবে জাতিসংঘের শ্রম বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন মহল থেকে মালয়েশিয়ায় হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিকের বেকার থাকার অভিযোগ উঠেছে।
বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'আমার এজেন্সি মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর সঙ্গে জড়িত নয়, তাই মালয়েশিয়ার নিয়োগকারীদের দেওয়া কোনো ভুয়া চাহিদাপত্র সম্পর্কে আমি জানি না।'
তিনি বলেন, গতকাল পর্যন্ত প্রায় ৩০০ কর্মী বিমানে উঠতে পারেননি। তবে শুক্রবার তাদের জন্য বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় তাকে জানিয়েছে।
কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে অভিবাসী কর্মীদের লম্বা লাইন
গতকাল মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অভিবাসী কর্মীদের ভিড়ে উপচে পড়েছিল। এই কর্মীদের বেশিরভাগই স্বল্প-দক্ষ এবং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
ইমিগ্রেশন ডিরেক্টর-জেনারেল রুসলিন জুসোহ-র বরাত দিয়ে ফ্রি মালয়েশিয়া টুডে এক প্রতিবেদনে বলেছে, বিমানবন্দরটির টার্মিনাল ১ ও ২ সাধারণত প্রতিদিন ৫০০ থেকে ১,০০০ বিদেশী কর্মী গ্রহণ করে। তবে ২৭ মে এই সংখ্যা ছিল সাড়ে ৪ হাজার।
নিয়োগকারীরা ১ জুনের সময়সীমার আগমুহূর্তে হুড়মুড় করে কর্মী নেওয়ার কারণে এরকম ভিড় তৈরি হয়েছে।
গত ১ মার্চ মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, বিদেশি কর্মীদের জন্য অব্যবহৃত কোটা ১ জুন বাতিল করা হবে। এই পদক্ষেপের লক্ষ্য নতুন কর্মী নিয়োগের জন্য কোটার সংখ্যা বাড়ানো, কারণ গত বছরের মার্চ থেকে কোটা বরাদ্দ বন্ধ রাখা হয়েছিল।
এক বিবৃতিতে জুসোহ বলেছেন, এয়ারলাইন্সগুলো ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তাই অভিবাসন বিভাগ আশা করছে, আগামীকাল পর্যন্ত কর্মী আগমনের সংখ্যা বাড়বে।
কুয়ালালামপুরেভিত্তিক অভিবাসী কর্মী অধিকার বিশেষজ্ঞ অ্যান্ডি হল এই কর্মীদের কল্যাণ ও কর্মসংস্থানের অবস্থা নিয়ে টিবিএসের কাছে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, 'এই কর্মীদের অনেকেই মালয়েশিয়ায় জোরপূর্বক শ্রমের জন্য বাংলাদেশি কর্মী পাচারকারী ক্রিমিনাল সিন্ডিকেটের শিকার। সম্প্রতি দেশটিতে প্রবেশের গড় খরচ জনপ্রতি ৬ হাজার ডলার হয়ে গেছে। ভুয়া নিয়োগকারীর কাছে এসে কাজ না পেয়ে অনেকেই আধুনিক দাসত্বের উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, এজেন্সি ও মধ্যস্থতাকারীরা এই ভুয়া নিয়োগকারীদের সহায়তা করে।'
মালয়েশিয়ার অভিবাসী ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের সমালোচনা করে হল বলেন, 'ক্রমবর্ধমান দায়মুক্তি, দুর্নীতি এবং আইনের শাসনের অভাবে ব্যবস্থাটি স্পষ্টতই ভেঙে পড়েছে। ভুক্তভোগীর সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক দাসত্বের ঝুঁকিও বাড়ছে।'