সৌরশক্তি যেভাবে ঘূর্ণিঝড়ের সময়েও চর আব্দুল্লাহর বাসিন্দাদের যোগাযোগের মধ্যে রেখেছিল
ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে বিদ্যুৎ না থাকায় উপকূলীয় এলাকাসহ দেশজুড়ে সারা প্রায় ৩৩ হাজার মোবাইল টাওয়ার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মূল ভূখণ্ডে মোবাইল টাওয়ারে নেটওয়ার্ক না থাকলেও তীব্র ঝড়ের সময়ও নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ করতে পেরেছে লক্ষ্মীপুরের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চর আবদুল্লাহর বাসিন্দারা।
ঝড়ের সময় মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লক্ষ্মীপুর জেলার উপকূলের মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দারা ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তথ্য ঠিকমতো পায়নি। সে কারণে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় তারা।
তবে মূল ভূখণ্ডে যখন সবার ফোন নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন ছিল, তখন মেঘনা নদীর ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের চর আব্দল্লাহর সব বাসিন্দার ফোনেই নেটওয়ার্ক সচল ছিল। তাই প্রতি মুহূর্তে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এ দ্বীপের বাসিন্দারা ঝড়ের খবর পাচ্ছিল।
এই ছোট্ট দ্বীপটির নেটওয়ার্ক কীভাবে অক্ষত ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর আছে দ্বীপের সৌরবিদ্যুৎচালিত মোবাইল টাওয়ারে।
প্রায় এক দশক আগে এ দ্বীপের জনতা বাজার এলাকায় একটি টাওয়ার স্থাপন করে মোবাইল অপারেটর রবি। টাওয়ারটি সৌরবিদ্যুৎচালিত। তাই ঝড়-বৃষ্টি আর জলোচ্ছ্বাসে কখনোই এ টাওয়ারে সমস্যা হয়নি। চরটির প্রায় ৬ হাজার বাসিন্দার মধ্যে, যারা মোবাইল ব্যবহার করে এদের প্রত্যেকেই রবি সিম কার্ড ব্যবহার করেন। এতেই ঘূর্ণিঝড়ের দিন নিরবচ্ছিন্ন সেবা পেয়েছে তারা।
চর আব্দুল্লাহর তেলিয়াচরের বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন টিবিএসকে ফোনে বলেন, ঝড়ের মধ্যে তার ইন্টারনেট সংবলিত মোবাইল হয়ে উঠেছিল গুরুত্বপূর্ণ লাইফলাইন। ইন্টারনেট সংযোগ চালু থাকায় তিনি সারাক্ষণই ঘূর্ণিঝড়ের খবর জানতে পেরেছেন, সেইসঙ্গে বহু মানুষকে জানাতে পেরেছেন ঝড়ের তথ্য।
সাদ্দাম বলেন, 'এ সুযোগটা হয়েছে শুধুমাত্র মোবাইল টাওয়ারে সৌরবিদ্যুৎ থাকার কারণে। কিন্ত টাওয়ারটিতে লাইনের বিদ্যুৎ থাকলে হয়তো সেটি সচল থাকত না। তখন ঝড়ের খবর এমনকি চরের অন্য বাসিন্দাদের খবরও জানানো যেত না।'
শিল্পসংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, রবির প্রায় ১৩ শতাংশ নেটওয়ার্ক সাইটে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। অন্যান্য অপারেটর সৌরবিদ্যুৎ অনেক কম ব্যবহার করে।
এদিকে চর আবদুল্লাহর আশেপাশের দ্বীপ, এমনকি মূল ভূখণ্ডেও অন্যদের ঝড়ের অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন। ঝড়ের দিন থেকে রবিসহ সব মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্ক অন্তত দুই দিন সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল।
সোমবার ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত ও তীব্র জোয়ারের সময় আরও কয়েকজনের সঙ্গে মেঘনা নদীর নামহীন একটি চরে ছিলেন মহিষের রাখাল ফিরোজ (২৭)। চরটি লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলার সীমানা বরাবর মূল ভূখণ্ড থেকে ২ কিলোমিটার পশ্চিমে। সেই চরে তারা গিয়েছিলেন মহিষ চরাতে।
ফিরোজ জানান, তারা প্রত্যেক রাখালই নিজেদের ফোনে একাধিক কোম্পানির সিম ব্যবহার করেন। কিন্ত রোববার মাঝরাত মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত কোনো অপারেটরের সিমেই নেটওয়ার্ক ছিল না। দুই দিন পর একজন মহিষ মালিক নৌকা নিয়ে এসে তাদেরকে ওই প্লাবিত চর থেকে উদ্ধা করেন।
ফিরোজ বলেন, 'ফোনের নেটওয়ার্ক চলে যাওয়ার পর আমরা মূলত তথ্য অন্ধকারে চলে যাই। এরপর কী হতে যাচ্ছিল আর কিছুই জানতে পারলাম না। কারও কাছে ফোন দিয়েও জানতে পারিনি।'
ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস জানার পরপরই ঢাকা থেকে নিজ এলাকা লক্ষ্মীপুরের মেঘনাতীরে ফিরে যান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ান।
ঝড়ের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ঝড়ের সময় ফোনে নেটওয়ার্ক ছিল না। বিদ্যুৎ না থাকায় বন্ধ ছিল টাওয়ার। ফলে ঢাকায় রেখে আসা স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না।
এ অভিজ্ঞতা থেকে সাত্তার দাবি করেন, উপকূলীয় এলাকায় প্রত্যেক মোবাইল অপারেটর যেন অবশ্যই তাদের টাওয়ারগুলোতে সৌরবিদ্যুৎ সংযোগ দেয়। 'উপকূলীয় অঞ্চলে এখন মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকলে হাজার চেষ্টা করেও মানুষকে দুযোর্গের কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না।'
সৌরবিদ্যুৎচালিত মোবাইল টাওয়ার কেন নয়?
রবির চিফ কর্পোরেট এবং রেগুলেটরি অফিসার মোহাম্মদ শাহেদুল আলম টিবিএসকে বলেন, মোবাইল টাওয়ার চালানোর জন্য পুরোপুরি সৌরবিদ্যুতের নির্ভর করা এখনও সম্ভব নয়। কারণ সূর্যালোক কতক্ষণ পাওয়া যায়, তার ভিত্তিতে সাধারণ সোলার প্যানেল ৫ থেকে ৮ ঘণ্টা একটি টাওয়ার চালাতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আরও ব্যাপক পরিসরে মোবাইল টাওয়ারে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার সরকারি সহায়তার ওপর নির্ভর করে।
শাহেদুল আলম বলেন, 'ঘূর্ণিঝড় রেমাল আমাদের সবাইকে একটা শিক্ষা দিয়েছে—আমাদেরকে দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎ বিভ্রাটের বিরুদ্ধে লড়তে করতে হবে। এবং সর্বোচ্চ প্রস্তুতিতে প্রচুর বিনিয়োগের জন্য টেলিকম শিল্পের উৎসাহ, প্রণোদনা ও সহায়তা প্রয়োজন।'
উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে তার কোম্পানি সাইটগুলোতে সমস্ত কার্বন ব্যাটারি সরিয়ে আধুনিক লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি বসিয়েছে। 'এ ধরনের বিনিয়োগে সহায়তা দিয়ে সরকার বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে পারে।'
শাহেদুল আলম বলেন, সাত বছরের মধ্যে সৌর প্যানেলে বিনিয়োগকারীর টাকা উঠে আসার কথা। এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ায় এই টাকা আরও কম সময়ে উঠে আসা উচিত।