বাংলাদেশ ব্ল্যাকলিস্ট: আপনি কি প্রতারিত হয়েছেন? এখানে রিপোর্ট করুন এবং অন্যদের বাঁচান
অনলাইনে প্রতারণার পদ্ধতি ও ধরনের যেন শেষ নেই। এটি অনেকটাই গ্রিক পুরাণে বর্ণিত হাইড্রা নামের সেই দৈত্যের মতো, যেটির মাথার সংখ্যা ছিল একাধিক। এই হাইড্রার যেমন একটি মাথা কেটে ফেলার পর ওই স্থানে পুনরায় দুটি মাথা গজাতো, অনলাইনে প্রতারণার বিষয়টিও যেন ঠিক তেমনই। অর্থাৎ যখনই আপনি প্রতারকদের একটি কৌশল ধরে ফেলবেন, তখন তারা কৌশল পাল্টে নতুন কোনো কৌশল নিয়ে হাজির হবে।
সামিউল ইসলাম নামের এ ব্যক্তির কথাই ধরুন, যিনি একটি উপহারের কার্ডের জন্য ফেসবুকে একটি ব্যবসায়িক পেজে ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন। প্রথম দিকে সন্দেহ হলেও পরে বুঝতে পারেন যে তিনি আসলে প্রতারিত হয়েছেন। একপর্যায়ে তিনি পেজটির কর্তৃপক্ষের কাছে তার টাকা ফেরত চান। তখনই প্রতারণার কথা স্বীকার করে তাকে বলা হয়, "আমরা আপনাকে প্রতারিত করেছি, ভাই। এখন মাত্র ৫০০ টাকার জন্য কান্নাকাটি করবেন না।'
এ কথা বলেই পেজটি থেকে তাকে ব্লক করে দেওয়া হয়। কয়েক দিন পর ফেসবুক থেকেই পেজটি উধাও হয়ে যায়।
সামিউলের তখন নিজেকে খুবই অসহায় মনে হয়েছিল। তিনি মনে মনে এও ভেবেছিলেন যে পুলিশ মাত্র ৫০০ টাকার জন্য তাদের সময় ব্যয় করবে না। প্রতারিত হওয়ার পর অনলাইনভিত্তিক এসব পেজের ওপর সামিউলের আর কোনো আস্থা নেই।
সবশেষে তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ''আমার আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।''
সামিউলের মতো আরও অনেকেই প্রতারিত হয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, তিনি এক্সক্লুসিভ ফোন কাভার বিডি নামের একটি ফেসবুক পেজে ফোনের তিনটি কাভার অর্ডার করেছিলেন। এজন্য অগ্রিম ৫০০ টাকাও দিয়েছিলেন তিনি। টাকা দেওয়া মাত্রই ওই পেজটি বন্ধ হয়ে যায়।
প্রতিদিনই শত শত মানুষ অনলাইন মার্কেটে প্রতারিত হচ্ছেন। এ মার্কেটগুলোর বিক্রেতারা বেশিরভাগই অপরিচিত হয়ে থাকেন। এজন্য সহজে তাদের অবস্থান জানা কিংবা ধরাও যায় না, যা পণ্য কেনা-বেচার ক্ষেত্রে একটি অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ তৈরি করছে।
এছাড়া তদারকির অভাবেও প্রতারকরা নির্বিঘ্নে এসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। ফেসবুক নিজেও এসব কর্মকাণ্ডের জন্য দায় নেয় না। তাই ভুক্তভোগীদের আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করারও কোনো জায়গা নেই।
তবে ফোনের কাভার কিনতে চাওয়া ওই ব্যক্তি প্রতারিত হয়ে অন্যদের মতো চুপ করে বসে থাকেননি। তিনি বাংলাদেশ ব্ল্যাকলিস্ট ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি অভিযোগ করেন।
অনুমোদিত সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ব্ল্যাকলিস্টের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রন আহমেদ জানান, বাংলাদেশ ব্ল্যাকলিস্ট বা সংক্ষেপে বিডি ব্ল্যাকলিস্ট মূলত প্রতারকদের মোকাবিলায় বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য একটি ডিজিটাল ঢাল বা ব্যবস্থা। এটি যেকোনো ধরনের জালিয়াতি যেমন আর্থিক, ভুয়া কোনো অফার বা ই-কমার্সসহ সব ধরনের জালিয়াতির শিকার ভুক্তভোগীদের অভিযোগের জায়গা হিসেবে কাজ করছে।
আপনি যদি ফোনের কেসিং, কাভার কিংবা নেটফ্লিক্স অ্যাকাউন্টের মতো ডিজিটাল পণ্য বা সেবা নিতে গিয়ে প্রতারিত হন, তাহলে বাংলাদেশ ব্ল্যাকলিস্ট আপনার জন্য। এখানে আপনি প্রমাণসহ একটি অভিযোগ করতে পারেন এবং এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধের জন্য ভূমিকা রাখতে পারেন।
মাত্র কয়েক মাস আগে চালু হওয়া ওয়েবসাইটটি খুব দ্রুতই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ওয়েবসাইটের পাশাপাশি একটি অ্যাপও রয়েছে তাদের, যেটি গুগল প্লে স্টোরে পাওয়া যায়।
এছাড়াও মানুষকে সতর্ক করার জন্য সাইবার সিকিউরিটি ও অনলাইন নিরাপত্তার বিষয়ে বিনামূল্যে অনলাইন কোর্সের পরিকল্পনা করছে বিডি ব্ল্যাকলিস্ট।
এ উদ্যোগের লক্ষ্য হলো- ব্যবহারকারীদের বিশেষ করে তরুণ ও প্রবীণ নাগরিকদের সচেতনতা বাড়ানো, যাতে তারা প্রতারণার বিষয়গুলো শনাক্ত করতে পারেন এবং তা এড়িয়ে চলতে পারেন।
বাংলাদেশ ব্ল্যাকলিস্টের প্রধান নির্বাহী (সিইও) নেওয়াজ আকবর হোসেন বলেন, "আমরা আরও সচেতন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী তৈরির জন্য শিক্ষামূলক ভিডিও বানানোর কথা ভাবছি।"
এটি যে প্রতারকদের ধরবে তা নয়। ভুক্তভোগীদের কাছে চ্যাট হিস্টোরির মতো কিছু প্রমাণ থাকলেও তারা এক্ষেত্রে নিজেদের অসহায় মনে করে থাকেন। কারণ তারা যে পরিমাণ অর্থ প্রতারিত হন, তা খুবই সামান্য। আর এ কারণে প্রতারকদের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো আইনি পদক্ষেপও আশা করা যায় না। প্রতারণার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীদের সোচ্চার হওয়ার জন্যই এ প্ল্যাটফর্ম।
ওয়েবসাইটটিতে কারো অভিযোগ তুলে ধরার আগে প্রথমে সেটির সত্যতা যাচাই করে নেওয়া হয়। তারপর মানুষকে সচেতন করার জন্য সেগুলো ওয়েবসাইটে তুলে ধরা হয়। যে কেউই এ ওয়েবসাইট থেকে এসব পেজ বা মার্কেট সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন এবং কোনটির সাথে লেনদেন করা উচিত, কোনটির সাথে উচিত নয়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
বিডি ব্ল্যাকলিস্টের সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন। তারাই তাদের কাছে আসা অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করে সেগুলো ডেটাবেসে সংরক্ষণ করেন। তাদের সাথে কিছু স্বেচ্ছাসেবীও রয়েছেন।
একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই এ প্ল্যাটফরম তৈরির অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্ল্যাকলিস্টের সিইও নেওয়াজ।
তিনি বলেন, ''আমি নিজেই অনলাইনের সুবিধা নিয়েছিলাম। প্রথমে আমার নিজেকেই বোকা মনে হয়েছিল। কিন্তু পরে জানলাম যে প্রতারণা ও জালিয়াতি করে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।"
তিনি যোগ করেন, ''কোনো পোস্ট ও সংবাদ যাচাই করার জন্য ফেসবুক যেভাবে লোকাল ফ্যাক্ট-চেকারদের ওপর নির্ভর করে, তেমনি প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত অ্যাকাউন্টগুলো নির্মূল করতে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য ফেসবুক আমাদের মতো ফ্রড-চেকারদের সাথে কাজ করতে পারে।''
বিডি ব্ল্যাকলিস্টের সদস্যরা মনে করেন, টাকার পরিমাণ যাই হোক না কেন, সেটি বিষয় নয়। হোক তা ৫০০ টাকা কিংবা ৫ লাখ। বিষয় হলো অপরাধকর্ম সংঘটিত হচ্ছে। মানুষের ক্ষতি হচ্ছে এবং এ অপরাধ ঠেকানোর একটি উপায় আছে।
যে কেউ বিডি ব্ল্যাকলিস্টের ওয়েবসাইটে ( https://bdblacklist.com.) বিনামূল্যে এবং নিজের নাম-পরিচয় গোপন রেখে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। ই-কমার্স জালিয়াতি, ফেসবুক জালিয়াতি, অনলাইনে কোনো পণ্য কেনার ক্ষেত্রে জালিয়াতি, ভুয়া সরকারি ওয়েবসাইটসহ বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতির বিষয়ে অভিযোগ করার সুযোগ রয়েছে প্ল্যাটফর্মটিতে। ব্যবহারকারীদের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে এটি অভিযোগের ক্ষেত্রের পরিধি আরও বাড়াতে চায়।
কভিড-১৯ এর টিকা কর্মসূচির সময় অনলাইনে একাধিক ভুয়া সরকারি ওয়েবসাইট ছড়িয়ে পড়েছিল, যেখানে মাত্র ৫০০ টাকায় করোনার টিকা ও কার্ডের মতো পরিষেবার কথা বলা হয়েছিল।
মানুষের অনলাইন কার্যক্রম বাড়ার সাথে সাথে প্রতারণার ঘটনাগুলোও বেড়েই চলেছে।
যদিও সমস্যাটি কাঠামোগত। ফেসবুক আইডি খোলার ক্ষেত্রে অনেক তথ্যের সঠিক যাচাই-বাছাই হয় না। এ কারণে প্রতারকরা খুব সহজেই আইডি খুলতে পারেন। আইডিতে প্রয়োজনীয় তথ্য না থাকায় প্রতারকদের অবস্থান খুঁজে বের করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
অনলাইনে কিছু বিক্রেতা নিম্নমানের পণ্য বিক্রি করে, ভালো পণ্য দেখিয়ে খারাপ পণ্য বিক্রি করে, আবার ক্রেতার কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়ে গেলে উধাও হয়ে যায় কিংবা ক্রেতাকে ব্লক করে দেয়।
এ ওয়েবসাইটে জালিয়াতির ধরন, সংখ্যা, পদ্ধতি, আর্থিক ক্ষতি, যোগাযোগ কৌশল ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য তুলে ধরা হয়ে থাকে। তাই ভবিষ্যতে জালিয়াতি বা প্রতারণা সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে এসব তথ্য সহায়ক হতে পারে বলে মনে করেন বিডি ব্ল্যাকলিস্টের সদস্যরা।
এটি একটি অলাভজনক উদ্যোগ। মূল কোম্পানি বাংলাদেশ সাইবারসিকিউরিটির আরেকটি সাইবার সিকিউরিটি শাখার তহবিল দিয়ে ওয়েবসাইটটি পরিচালিত হয়।
নেওয়াজ জানান, ব্যবহারকারীরা বিনামূল্যে ওয়েবসাইটটি ব্যবহার করতে পারবেন।
বাস্তব জীবনে প্রভাব
অনলাইনে প্রতারণায় যে মানুষের কেবল আর্থিক ক্ষতিই নয়, বরং তাদের বহুমুখী ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন- ড্রাইভ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হারিয়ে ফেলা, কিংবা ধরুন আপনি জন্মদিনের কেক অর্ডার করেছিলেন, কিন্তু সেটি পাননি। আবার হতে পারে আপনাকে করোনা টিকার ভুয়া সনদ দেওয়া হয়েছে। যেটির কারণে আপনি আপনার নির্ধারিত ফ্লাইট মিস করেছেন। এভাবে হিসাব করতে গেলে দেখা যায়, অনলাইন থেকে কেনা কোনো পণ্য বা সেবার সাথে আমাদের জীবন কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে।
ফ্রিল্যান্স ভিডিও এডিটর জায়েদ হোসেন বলেন, "আমি আমার পিঠের ব্যথা কমানোর জন্য একটি আর্গোনমিক চেয়ার কিনেছি। তারা (অনলাইনের বিক্রেতারা) বিজ্ঞাপনে এটিকে শীর্ষস্থানীয় আমদানি করা পণ্য হিসেবে দেখিয়েছিল। কিন্তু তারা আমাকে স্থানীয়ভাবে তৈরি সস্তা একটি চেয়ার দিয়েছে, যা দিয়ে আমার পিঠের ব্যথার কোনো উপকার হয়নি। পরে আমি এর রিভিউ দিয়েছিলাম। কিন্তু সেটি কেউ পড়েছে কি না সন্দেহ।''
চেয়ারটি ২০ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছিলেন বলে জানান জায়েদ।
নেওয়াজ বলেন, ''এটি বন্ধ করতে হবে।''
তিনি বলেন, "আমরা জানি প্রতারকরা সবসময় নতুন কৌশল তৈরি করবে। কিন্তু আমরা তাদের ঠেকাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের মুখোশ খুলে ফেলব এবং তাদের দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতি কমিয়ে আনব।"
নেওয়াজ বলেন, ''যারা এসব প্রতারণার বিরুদ্ধে কাজ করতে চান, তাদের আমরা আমাদের দলে স্বাগত জানাই।''
বাংলাদেশের ব্ল্যাকলিস্ট ফ্রড-চেকিং সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে চায়। কারণ তাদের সদস্য ও শক্তি যত বাড়বে, তারা ততো কঠিনভাবে এসব প্রতারকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারবে।
নেওয়াজ বলেন, ''বিস্তৃত ও সহযোগিতামূলক নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে আমরা অপরাধীদের দ্রুত শনাক্ত করতে পারব ও তাদের প্রতারণার হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারব।''