জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো সেই গন্ধগোকুল উদ্ধার
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে রবিবার থেকে এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়ানো গন্ধগোকুলটিকে অবশেষে উদ্ধার করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন, এটি (গন্ধগোকুলটি) র্যাবিস বা এজাতীয় কোনো ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।
সোমবার (১ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে থেকে প্রাণীটিকে উদ্ধার করা হয়। এসময় প্রাণীটি বেশ দুর্বল অবস্থায় ছিল।
এর আগে গতকাল রাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকায় এলোমেলো ভাবে ঘুরতে দেখা যায় প্রাণীটিকে।
স্বাভাবিকভাবে সব সময় লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা এবং লাজুক স্বভাবের এই প্রাণীটিকে অস্বাভাবিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতে দেখে প্রাণীটিকে ঘিরে ব্যাপক কৌতুহলের সৃষ্টি হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে প্রাণীটির এমন আচরণের জন্য ক্রমাগত বণ্যপ্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকেও দায়ী করেন অনেকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানান, মূলত গতকাল রাত থেকে গন্ধগোকুলটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতে দেখেন শিক্ষার্থীরা। সর্বপ্রথম এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের আশেপাশে দেখা যায় বলে দাবি করা হয়। পরবর্তীতে আজ সকালে এটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনেও দেখা যায়।
এসময় মীর মোশাররফ হোসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ও প্রাণীবিদ্যা বিভাগের ৪৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম রবি গন্ধগোকুলটির একটি ভিডিও ধারণ করে তার ফেসবুকে পোস্ট করেন।
রবিউল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস)-কে বলেন, গতকাল রাতে আমরা সর্বপ্রথম এটির কথা জানতে পারি। তখন প্রাণীটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের পাশে দেখা যায়। কিন্তু রাতে আমরা সেখানে গিয়ে আর এটিকে দেখতে পাইনি। পরে আজ সকালে আবার হলের সামনে এটি এলে আমরা এর কিছু ছবি তুলি এবং ভিডিও করি। পরে শিক্ষকদের জানালে তারা এটিকে উদ্ধারের উদ্যোগ নেন।
প্রাণীটিকে উদ্ধারে সরাসরি সহযোগীতা করা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী রিপন রায়হান টিবিএসকে বলেন, 'সকালে এটিকে মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে দেখা গেলেও এটিকে আটকানো যায়নি। যেহেতু এটি অসুস্থ, তাই এটিকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বিকালে যখন আবারও এটিকে মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে দেখা যায়, তখন আমি সেটিকে খুব সাবধানে উদ্ধার করে শিক্ষকদের জানাই। পরে শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে প্রাণীটিকে উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারে নেওয়া হয়।
প্রাণীটিকে উদ্ধারে নেতৃত্ব দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান টিবিএসকে বলেন, 'বাংলায় এটিকে গন্ধগোকুল বা বাগডাশ বলা হয়। এটি অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের একটি প্রাণী, সচরাচর এটিকে মানুষের আশেপাশে আসতে দেখা যায়না। নিশাচর প্রাণী হওয়ায় এটি রাতেই খাবারের সন্ধানে বের হয়, রাতে বের হলেও এটিকে কোনভাবেই মানুষের আশেপাশে দেখা যায় না।'
তিনি বলেন, 'কিন্তু এই প্রাণীটির ক্ষেত্রে যেটি হয়েছে, এটি গতকাল রাতে প্রথম দেখা গিয়েছিল বলে আমরা জেনেছি। এবং এটি আসলে যেভাবে এবনরমাল ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটি শুধুমাত্র অসুস্থ হলেই সম্ভব। মুখ থেকে লালা ঝড়ছে এটির। ধারণা করা হচ্ছে র্যাবিস বা এজাতীয় কোনো ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। কাজেই কোনোভাবে যেন এটি থেকে অন্য প্রাণীতে ভাইরাস না ছড়িয়ে পড়ে এবং এটির চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেই আমরা এটিকে উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। যদিও র্যাবিস আক্রান্ত হয়ে গেলে বাঁচবে কিনা সেটি নিশ্চিত না।'
এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য প্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস হওয়া প্রসঙ্গে এই শিক্ষক বলেন, 'দেখেন নগরায়ন হলে সেখানে পরিবেশের ওপর কিছু না কিছু প্রভাব তো পড়েই। কিন্তু এই প্রাণীটির ক্ষেত্রে যা বলা হচ্ছে তা না জেনেই বলা হচ্ছে। আবাসস্থল ধ্বংস হলেও এভাবে এই প্রাণী মানুষের সামনে আসবে না। অসুস্থতার কারণেই একে এভাবে দেখা যাচ্ছে।'
প্রাণিটিকে উদ্ধারের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশন-এর সাধারণ সম্পাদক (জাবি শাখা) সায়েদা অনন্যা ফারিয়া টিবিএসকে বলেন, হটলাইনে খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে এসেছি। দেখে মনে হচ্ছে এটি অসুস্থ, প্রাণীটির মুখ থেকে লালা ঝড়ছে। এখন শিক্ষকদের সহায়তায় প্রাণীটিকে উদ্ধার করে ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারে নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, 'বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসবাস করা বিভিন্ন প্রাণীদের আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এই প্রাণীটির এভাবে ঘুড়ে বেড়ানোর কারণ ভিন্ন। তবুও আমরা চাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের মতোই মানুষ ও প্রাণীর যেই সহাবস্থান ছিল, সেটি টিকে থাকুক। এই ক্ষেত্রে প্রশাসনের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে যেন মাস্টার প্লানের মাধ্যমে সব দিক মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হাতে নেওয়া হয়। এতে আমরাও ভালো থাকবো পাশাপাশি পরিবেশ, প্রকৃতি ও প্রাণীরাও ভালো থাকবে।'