‘ও আব্বা তুমি যাইও না যেন আব্বা! আমার আসিফ আর নেই!’
১৮ জুলাই বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আসিফ হাসান রাজধানীর উত্তরা এলাকায় কোটা আন্দোলনের সংঘর্ষে গুলিতে নিহত হন। ফেসবুকে আসিফের গুলিবিদ্ধ ছবি দেখার পর- পরিবার থেকে তার নিহতে হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় বেলা ৩টার দিকে। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে মা শিরিন বেগম বারবার মুর্ছা গেছেন। শোকস্তব্ধ বাবা।
মা শিরিন বেগম আহাজারি করে বলছেন: 'বাবা, তোরে নিষেধ করলাম। বললাম, ও আব্বা তুমি যাইও না যেন, আব্বা তা-ও গেছে। …আমার আসিফ চলি গেছে। আসিফ বাবা আর নেই।'
আসিফ হাসানের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার আস্কারপুর গ্রামে দলে দলে তার বাড়িতে আসছেন আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীসহ নিকটজনরা। আসিফের বাল্যবন্ধুরাও অনেকে এসেছেন। বন্ধুকে হারিয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে তারা।
বাড়ির উঠানে আমগাছতলায় চেয়ারে বসা আসিফের বাবা মাহমুদ গাজী। শোকে স্তব্ধ, কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন আত্মীয়স্বজনেরা। কিন্তু সন্তানহারা বাবা কি আর কথায় সান্ত্বনা পা! চোখের কোণ দিয়ে পানি ঝরছে তার অবিরল।
এই দৃশ্য আসিফ হাসানের বাড়ির, ১৮ জুলাইয়ের বিকেলের। আসিফের নিথর দেহ তখনও ঢাকায়। শোকস্তব্ধ বাড়িতে তখন খবর আসে আসিফের মরদেহ বাড়িতে আনার চেষ্টা করছেন ঢাকা বসবাসরত বোন মুক্তি পারভীন ।
আসিফের স্কুলশিক্ষক আবুল হাসান বলেন, 'আসিফ খুব শান্ত প্রকৃতির ছেলে ছিল। রাজধানীর নর্দান ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল সে। খুব মেধাবী। শিক্ষাঙ্গন আজ এভাবে রক্তাক্ত। ছাত্রদের বুকে গুলি…আমরা এমন মৃত্যু দেখতে চাই না।'
এইটুকু বলে আর কিছু বলতে পারলেন না তিনি। চুপ হয়ে গেলেন।
মিডিয়াকর্মী দেখে কেউ কেউ ক্ষোভ জানাচ্ছেন: 'আপনারা সঠিক ঘটনা জাতির সামনে তুলে ধরেন না। এখন এখানে কেন এসেছেন? আপনারা চলে যান। শুক্রবার (১৯ জুলাই) জুমার নামাজের পর জানাযা হবে, তখন আসবেন। এখন যান আপনারা।'
ওইদিন রাত দেড়টার দিকে আসিফ হাসানের মরদেহ ঢাকা থেকে বাড়িতে পৌঁছায়। তখনও বাড়িতে হাজারো মানুষের উপস্থিতি। গুলিতে আসিফের বুক ঝাঁঝরা। মরেদহ পৌঁছার পর বাড়িজুড়ে আবার কান্নার রোল পড়ে যায়।
প্রথমে নিকটাত্মীয়রা জানান, আসিফের জানাযা শুক্রবার জুমার নামাজের পর হবে এমন সিদ্ধান্ত হলেও চাপ ছিল দ্রুত দাফন করার। সে কারণে শুক্রবার ফজরের নামাজের পরইপরই ভোর সাড়ে ৬টার দিকে দাফন শেষ করা হয়।
তিন বোনের পর আসিফ হাসান ও রাকিব হাসান যমজ দুই ভাই। আসিফ আজ নেই, রাকিব সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে অনার্স পড়ছেন। ভাইয়ের মৃত্যুতে তিনিও পাগলপ্রায়। আসিফের মৃত্যুর নয় দিন পরও আতঙ্ক-শোক কাটেনি পরিবারটির।
স্থানীয় নওয়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন বলেন, 'রাত দেড়টার দিকে মরদেহ বাড়িতে পৌঁছানোর পর আমি দেখেছি। বুকটা একেবারেই ঝাঁঝরা, মাথার ডান পাশে গুলির চিহ্ন। কোটা আন্দোলনের মিছিলে গেলে রাজধানীর উত্তরা এলাকায় বেলা ১২টার দিকে সংঘর্ষের ঘটনায় গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যায় আসিফ। সম্ভবত ছাররা গুলি লেগেছে তার বুকে। মৃত্যুর খবর শুনেই আমি ওই বাড়িতে উপস্থিত হই। এরপর দাফন পর্যন্ত আমি ছিলাম।'