পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয়করণ: পদত্যাগের হিড়িকে অচল শিক্ষা কার্যক্রম
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয়করণের গভীরতা আগে থেকেই স্পষ্ট ছিল, তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্বেচ্ছায় বা ছাত্রদের জোরাজুরিতে পদত্যাগের সাম্প্রতিক ঢেউ এই দলীয়করণের সম্পূর্ণ তীব্রতা সামনে নিয়ে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পদত্যাগের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যত নেতৃত্বশূন্য ও অচল হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ইতিমধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়া শিক্ষা ব্যবস্থার আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়া ঠেকাতে সিনিয়র অধ্যাপকদের মধ্য থেকে অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য (ভিসি) নিয়োগ দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করার পরামর্শ দেন তারা।
শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর গত কয়েকদিনে অন্তত ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি ও ২১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি পদত্যাগ করেছেন বলে তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, এই শীর্ষ প্রশাসকদের অনেকেই হাসিনা সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে যুক্ত ছিলেন। একাডেমিক ও প্রশাসনিক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রায়ই যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক যোগাযোগকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হতো।
বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এম রিজওয়ান খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ক্ষমতায় থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসি ও প্রো-ভিসি পদে দলীয় নিয়োগ দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
আবার ভিসিরা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক পদগুলোতে যোগ্যদের বঞ্চিত করে আওয়ামীপন্থিদের নিয়োগ দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ কারণে সবার মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, 'ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে কিংবা নিজ থেকেই তারা এখন পদত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন।'
এর আগে কখনও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি জানিয়ে এম রিজওয়ান বলেন বলেন, 'আগে পটপরিবর্তন হলেও দুই-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া কাউকে পদত্যাগ করতে হতো না। বেশিরভাগই (ভিসি) তাদের মেয়াদ শেষ করতেন। কিন্তু অতি-দলীয়করণের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন পদত্যাগের হিড়িক দেখা যাচ্ছে।'
তিনি জানান, ভিসি নিয়োগ একটি জটিল প্রক্রিয়া। এ কারণে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্রুত ভিসি নিয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা কম।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ সংকট নিরসনে প্রয়োজনে অন্তর্বর্তীকালীন ভিসি নিয়োগের পরামর্শ দেন অধ্যাপক রিজওয়ান।
প্রধান পদগুলো শূন্য থাকলে সেশনজটসহ নানা ধরনের সংকট তৈরি হবে বলে সতর্ক করেন তিনি। 'ফলে ভিসি নিয়োগের আগপর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিনিয়র অধ্যাপকদের মধ্য থেকে অন্তর্বর্তীকালীন ভিসি নিয়োগ দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়, যেন স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত না হয়।'
শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বুধবার স্বীকার করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো ফাঁকা রেখে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা কঠিন। তিনি বলেন, এই পদগুলো দ্রুত পূরণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে—শিক্ষার্থীদের কাছে যাদের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে, তারা এই পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবেন।
উপদেষ্টা বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের যোগ্যতা, সক্ষমতা দেখা হচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষককে আমরা বেশি বিশ্বাস করি, তাদের কাছ থেকে শিক্ষকদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এছাড়া যেসব শিক্ষক সব শিক্ষার্থীর কাছে গ্রহণযোগ্য তাদেরকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।'
শিক্ষা উপদেষ্টা আরও বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক শীর্ষ পদগুলোতে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে, যারা দলীয়ভাবে বেশি ইনভলভড থাকবেন না, তাদের। নিয়োগের ক্ষেত্রে সাদা-নীল কোনো দল দেখা হবে না।'
পদত্যাগের হিড়িক
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল, প্রক্টরিয়াল বডি ও সাত হলের প্রাধ্যক্ষসহ অন্তত ২৪ জন পদত্যাগ করেছেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পেনশন স্কিম নিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলনে গত ১ জুলাই থেকে কার্যত অচল হয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
গত ৬ আগস্ট থেকে খুলে দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, ১৮ আগস্ট থেকে শুরু হয় ক্লাস-পরীক্ষা। তবে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো খালি থাকায় অচলাবস্থা বিরাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপচার্য অধ্যাপক ড. নুরুল আলম, উপ-উপাচার্য, প্রক্টর, রেজিস্ট্রার ও সাতজন প্রভোস্ট পদত্যাগ করেছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের, দুজন প্রো-ভিসি, ১৪ জন প্রভোস্ট, প্রক্টরিয়াল বডির ১১ জন ও ছাত্র উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার, প্রো-ভিসি, প্রক্টরিয়াল বডি ও প্রভোস্টসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা অন্তত ৭৫ জন পদত্যাগ করছেন।
এছাড়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ মোট ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদত্যাগ করেছেন। আর এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পুরো প্রক্টরিয়াল বডি পদত্যাগ করেছেন। ফলে এখনই ক্যম্পাস খুললে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষকরা।
সব মিলিয়ে দেশের ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভিসি, প্রো-ভিসি কিংবা ট্রেজারার পদ শূন্য রয়েছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন ৪২টি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন কার্যত প্রশাসন নেই। ফলে কোনো ঘটনা ঘটলে কেউ এর দায় নেবে না।
তিনি বলেন, এ কারণে আগে ভিসি নিয়োগ দিতে হবে। 'এখন থেকে দলীয়ভাবে আশা করছি নিয়োগ হবে না। যোগ্যতার ভিত্তিতেই নিয়োগ দিতে হবে। এ অভ্যুত্থান অনেক শিক্ষার্থীর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া।'