এখনও পানিবন্দি ৫১ লাখ মানুষ, বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে লাগবে আরও ৪ দিন
পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১১ জেলায় প্রায় ৫১ লাখ মানুষ এখনও পানিবন্দি। গত চার দিনের বন্যায় গতকাল (২৩ আগস্ট) সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ কামরুল হাসান জানান, নিহতদের মধ্যে কুমিল্লায় চারজন, ফেনীতে একজন, চট্টগ্রামে পাঁচজন, নোয়াখালীতে তিনজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন, লক্ষ্মীপুরে একজন ও কক্সবাজারে তিনজন রয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ১১ জেলায় প্রায় ৯ লাখ ৮০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
এছাড়া কাপ্তাই লেকের পানি বেড়ে যাওয়ায় গতকাল রাত ১০টায় কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৬টি স্পিলওয়ের গেট ৬ ইঞ্চি করে খুলে দেওয়ার কথা থকায় পাহাড়ি এলাকায় নতুন বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তবে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ এজন্য ভাটি অঞ্চলের বাসিন্দাদের আতঙ্কিত না হতে আহ্বান জানিয়েছে।
গত কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কাপ্তাই লেকে পানি বেড়ে সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছেছে। এ কারণেই গেটগুলো খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী এটিএম আব্দুজ্জাহের।
এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (এফএফডব্লিউসি) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল রাত ৯টা পর্যন্ত গত ৪০ ঘণ্টায় বন্যাকবলিত এলাকায় নদীর পানির উচ্চতা বাড়েনি; আর ফেনী ও কুমিল্লায় পানির উচ্চতা ধীরে ধীরে কমছে।
এফএফডব্লিউসির তথ্যানুসারে, বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে এবং নদীর পানির স্তর বিপৎসীমার নিচে নামতে আরও চার দিন সময় লাগতে পারে।
বন্যাকবলিত ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার দিকে শনিবার উদ্ধার অভিযান ও ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেছেন তানভীর হোসাইন নামের এক যুবক। এই স্বেচ্ছাসেবক বলেন, 'আমরা যতটুকু ভেবেছি, তার থেকেও অনেক ভয়াবহ অবস্থা এ এলাকায়। অধিকাংশ বাড়ির একতলার অধিকাংশ ডুবে গেছে।'
তিনি বলেন, 'আমরা একটি বোট নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু ওখানে ১০০-র ওপরে বোট নিয়ে গেলেও সবাইকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। অনেকে প্রধান সড়কের আশপাশে উদ্ধার কার্যক্রম ও ত্রাণ দিলেও গ্রামের ভেতরে মানুষ খুবই কম যাচ্ছে। প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে অনেক বেশি ত্রাণ সরবরাহ করা প্রয়োজন।'
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, আগামী তিন দিন দেশের কোথাও অতিভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা না থাকলেও বন্যা কবলিত এলাকাগুলোসহ উপকূলীয় তিন বিভাগের কিছু এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাতের (৮৮ মিমি পর্যন্ত) সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে গত কয়েকদিন যে অতিভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে, সেটার সম্ভাবনা নেই।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় ৩ লাখ ১ লাখ ৯৯৩ জন মানুষ ও ২১ হাজার ৬৯৫টি গবাদিপশুকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ৩ হাজার ৫১৩টি আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া ৭৬৯টি মেডিকেল টিম সক্রিয়ভাবে এই জেলাগুলোতে ক্ষতিগ্রস্তদের স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে।
বন্যা উপদ্রুত এলাকায় নদীর পানি বাড়েনি
এফএফডব্লিউসির তথ্যমতে, গতকাল রাত ৯টা পর্যন্ত কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, মেঘনা ও হালদা নদীর পানি গত ৪০ ঘণ্টায় ২০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত কমেছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে আশা করা হচ্ছে।
তবে কুমিল্লার গোমতী ও ফেনীর মুহুরী নদীতে পানি কমার গতি অত্যন্ত ধীর। নদী দুটিতে তিন ঘণ্টায় ৫ সেন্টিমিটারের মতো পানি কমেছে।
এফএফডব্লিউসির তথ্য অনুসারে, দেশের উত্তর-পূর্ব, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি কমতে শুরু করেছে।
তবে তা সত্ত্বেও ৮টি পয়েন্টে পানি এখনও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে অমলশীদ (কুশিয়ারা) স্টেশনে বিপৎসীমার ১১ সেন্টিমিটার, শেওলায় (কুশিয়ারা) ১ সেন্টিমিটার, শেরপুর-সিলেটে (কুশিয়ারা) ৭ সেন্টিমিটার, মারকুলীতে (কুশিয়ারা) ১ সেন্টিমিটার, মৌলভীবাজারে (মনু) ৬৬ সেন্টিমিটার, বাল্লায় (খোয়াই) ৩০ সেন্টিমিটার, কুমিল্লায় (গোমতী) ৯২ সেন্টিমিটার ও রামগড়ে (ফেনী) বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
গতকাল সকাল ৯টার পর থেকে দেশে বড় ধরনের বৃষ্টিপাত হয়নি।
এফএফডব্লিউসির নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান টিবিএসকে বলেন, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ অববাহিকাসমূহে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত পরিলক্ষিত হয়নি এবং উজানের নদ-নদীর পানি সমতল কমা অব্যাহত আছে। ফলে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলের বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত আছে।
আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ১৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদী সমূহের পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে এবং সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকতে পারে। আরও বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে, উত্তরাঞ্চলের তিস্তা-ধরলা-দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল সামগ্রিকভাবে স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
তিনি বলেন, 'আমাদের ধারণা, ২৮ আগস্টের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে। তবে পানি পুরোপুরি কমতে আরও সময় লাগবে।'
উদয় রাহান আরও বলেন, 'কাপ্তাই বাঁধ থেকে পানি ছাড়া হলেও বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির ওপর তা তেমন কোনো ফেলবে না আশা করি।'
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'বন্যা-প্লাবিত অঞ্চলে বৃষ্টি অনেকটা কমে এসেছে। তবে রোববার এসব এলাকাসহ উপকূলীয় তিন বিভাগে (চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনা) ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ বৃষ্টি বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। তবে বিচ্ছিন্নভাবে বৃষ্টি হতে পারে, যা বন্যায় খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'ভারতের ত্রিপুরাসহ ওই অঞ্চলে অতিভারী বৃষ্টি কমে গেলেও এখনও ভারী বৃষ্টি হচ্ছে কিছু কিছু এলাকায়। আগামী দুই-তিনদিন এসব এলাকায় বৃষ্টির প্রবণতা এমনটাই থাকতে পারে। এখন কোথাও লঘুচাপ নেই, আবহাওয়া মোটামুটি স্বাভাবিক।'
কুমিল্লায় নতুন এলাকা প্লাবিত
শনিবার পর্যন্ত বিগত ২৪ ঘণ্টায় কুমিল্লা জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এ সময় জেলায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে এবং সাত লাখ লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
এ সময়ে গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার ৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নৌকাস্বল্পতার কারণে রাস্তা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় স্বেচ্ছাসেবকরা বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করতে হিমশিম খাচ্ছেন।
সীতাকুণ্ড উপকূলের বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত
বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের কারণে সাগর উত্তাল থাকায় এবং ভারী বর্ষণ ও আকস্মিক বন্যায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলে বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড অন্তত চারটি এলাকায় বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে। বৃষ্টি কমলেও সীতাকুণ্ডের বড় অংশ জলাবদ্ধ হয়ে আছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, পূর্ণিমা ও নিম্নচাপের কারণে জোয়ারের উচ্চতা স্বাভাবিকের তুলনায় ছয় ফুট বেড়ে গেছে। জোয়ারের প্রবল স্রোতে বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের সিকদার খাল, আকিলপুর সৈকত, কুমিরা ইউনিয়নের আলেকদিয়া এবং সোনাইছড়ি ইউনিয়নের ঘোড়ামরা এলাকায় অন্তত চার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এখনও চালু হয়নি আখাউড়া স্থলবন্দরের কার্যক্রম
আখাউড়াসহ অন্যান্য এলাকায় বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছে।
গত ১২ ঘণ্টায় আখাউড়ায় হাওরা নদীর পানি ৪ সেন্টিমিটার কমে বর্তমানে বিপৎসীমার ৫১ সেন্টিমিটার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে।
তবে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা ও বাঁধের কারণে কিছু গ্রামে যোগাযোগ বন্ধ ও বিদ্যুৎবিভ্রাট হয়েছে।
যান চলাচল বন্ধ থাকায় আখাউড়া স্থলবন্দরে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এছাড়া বন্দরের আন্তর্জাতিক অভিবাসন চেকপোস্টের মাধ্যমে দর্শনার্থী বিনিময়ও ব্যাহত হয়েছে।