বন্যায় ৮.৫ লাখ টন চাল উৎপাদন কমে যাওয়ার শঙ্কা
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট মৌসুমী লঘুচাপ এবং ভারী বৃষ্টিপাতজনিত কারণে দেশে আকস্মিক বন্যায় অন্তত ১২টি জেলার আমন ধান, আমনের বীজতলা, আউশ ধান ও শাকসবজির চাষাবাদ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে।
এ বন্যায় যে পরিমাণ আউশ ও আমনের জমি আক্রান্ত হয়েছে তাতে করে অন্তত ৮.৫ লাখ টন চালের উৎপাদন নষ্ট হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, বন্যার কারণে ১২টি জেলায় ব্যাপকভাবে ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এর বাইরে বন্যা পরিস্থিতির কারণে আরও ১৫ জেলায় অল্প পরিমাণে বিভিন্ন ফসল ক্ষতির মুখে পড়েছে।
এ বন্যায় ২ লাখ ৯১ হাজার ৩৩ হেক্টর শুধুমাত্র ধানী জমিই আক্রান্ত হয়েছে, যেখানে চলতি মৌসুমের আমন ও আউশ ধান রয়েছে। গত মৌসুমের জাতীয় গড় (বিবিএসের গত মৌসুমের উৎপাদন গড়) ধরে হিসাব করলেও এই পরিমাণ জমিতে অন্তত ৮৪১,২৩৪ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হওয়ার কথা রয়েছে।
কৃষি বিভাগ বলছে, ১২টি জেলার যেসব ধানের জমি আক্রান্ত হয়েছে সেগুলোতে ধানের উৎপাদন পুরোপুরিই ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
এর বাইরে ১৯,৬৮০ হেক্টর জমিতে আমনের বীজতলা তৈরি করা ছিল, যা পুরোপুরি আক্রান্ত হয়েছে।
কৃষি বিভাগ বলছে— ধান, শাকসবজি, আদা, হলুদ, মরিচ, ফলবাগান, তরমুজ, পেপে, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ ও টমেটো, পান, আখ-সহ এবারের বন্যায় ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৩৮২ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। এই তালিকায় ধানের পরেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শাকসবজির উৎপাদন— যেগুলো একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে।
তবে কৃষি বিভাগ এখনো টাকার অঙ্কে এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করেনি।
যদিও মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, মাছ ও লাইভস্টক খাতে এখন পর্যন্ত ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির হিসাব করা সম্ভব হয়েছে।
দেশের ১২ জেলায় চলমান বন্যায় গবাদিপশু, হাস-মুরগি, পশুখাদ্য এবং মাছ ও মাছের পোনা, অবকাঠামো সহ এই খাতে এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে জানান মৎস ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
মৎস ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনা বিভাগে চলমান বন্যায় ১২টি জেলার ৮৬টি উপজেলায় মৎস খাতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। শুধু মৎস খাতেই ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে ১ হাজার ৫৯০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
এ খাতে ক্ষতিগ্রস্ত পুকুর/দীঘি/খামারের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৯৯টি। ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ ৯০ হাজার ৭৬৮ মেট্রিক টন। ক্ষতিগ্রস্ত মাছের পোনা ও চিংড়ির পোস্ট লার্ভা ৩ হাজার ৭৪৬ লাখ এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এছাড়া, উল্লিখিত ১২ জেলার ৮৬টি উপজেলার লাইভস্টক সেক্টকে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগির খাদ্য এবং অন্যান্য পশুখাদ্য বিনষ্ট হয়েছে। দুধ, ডিম, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগিসহ এখন পর্যন্ত এ খাতে ৪১১ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে।
উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, "আকস্মিক বন্যায় জানমালের ক্ষতিসহ মৎস ও প্রাণিসম্পদ খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেক গবাদিপশুর মৃত্যুর পাশাপাশি অনেক পশু পানিতে ভেসে গেছে।"
প্রাণিসম্পদ খাতের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তিনটি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, "জরুরি ভিত্তিতে পশুখাদ্য সরবরাহ ও বিতরণ করা হবে, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির রোগ প্রতিরোধে টিকা দেওয়া হবে এবং ঘাসের কাটিং বিতরণ করা হবে।"
এছাড়া, ক্ষতিগ্রস্ত মৎস খামারিদের পুনর্বাসনে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, মৎস খামারগুলোকে সুরক্ষিত করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সহায়তা প্রদান, মুক্ত জলাশয়ে পোনা অবমুক্ত কার্যক্রমের অর্থ বন্যা কবলিত এলাকার চাষীদের মাঝে পোনা বিতরণে ব্যবহার করা, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কতা ব্যবস্থার উন্নয়ন, মৎস চাষীদের জন্য বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কার্যক্রম চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন উপদেষ্টা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ–সংক্রান্ত দৈনিক প্রতিবেদনে রোববার বলা হয়, বন্যায় এখনো দেশের ১১টি জেলায় ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৮টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। এসব এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৭ লাখ ১ হাজারের বেশি। এখন পর্যন্ত বন্যায় ২৩ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে।