রাজশাহীর পদ্মায় কেন ইলিশের দেখা মেলে না?
গত শতাব্দীর ১৯৭০-এর দশক পর্যন্তও রাজশাহীর পদ্মায় মিলত ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। আকারে বড় ও স্বাদে অতুলনীয় ছিল সেই ইলিশ। দামে কম ও সহজলভ্য হওয়ায় আপামর জনসাধারণ ইলিশ খেতেন। কিন্তু পদ্মার উজানে ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার পর থেকে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এ নদীতে ইলিশের পরিমাণ কমতে কমতে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। তবে পদ্মার পানির গভীরতা বাড়ানো গেলে ও মা ইলিশ ধরা বন্ধ করা গেলে আবারও ইলিশের পুরনো সেই সুদিন ফেরানো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ইলিশ মাছ দ্রুত বেগে ছোটে এবং উজানের দিকে যেতে পছন্দ করে। চলাচল করে ঝাঁকে ঝাঁকে। এক এক ঝাঁকে শত শত ইলিশ থাকে। পাকিস্তান আমলেও বঙ্গোপসাগর থেকে উজানে রাজশাহী হয়ে ভাগলপুর পর্যন্ত যেত ইলিশ এবং ডিম ছাড়ত। চারঘাট থেকে পদ্মার শাখা বড়াল নদীর বাঘার আড়ানি অংশেও মিলত প্রচুর ইলিশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ১৯৭৪-৭৫ সাল পর্যন্ত রাজশাহীতে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যেত। তখন সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ঘরেই ইলিশ পাওয়া যেত।
মাহবুব সিদ্দিকী আরও বলেন, 'আমি ১৯৬০ সালের আগেও রাজশাহীর বাজার থেকে এক টাকা দিয়ে সোয়া কেজি ওজনের চারটি ইলিশ কিনেছি। পরিস্থিতি এমন ছিল যে ইলিশ খেতে খেতে অরুচি চলে আসত। সপ্তাহে তিনদিনই ইলিশ খাওয়া হতো। তখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও হাটে ইলিশ বেচা-কেনা হতো। অনেকেই ফেরি করে গ্রামে গ্রামে ইলিশ বিক্রি করতেন।'
ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার পর থেকে রাজশাহীতে ইলিশ কমতে থাকে বলে জানান তিনি। বাঁধের কারণে পদ্মায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় স্রোতও কমে যায়। ফলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অতিক্রম করে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ আসা বন্ধ হয়ে যায়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়ামিন হোসাইন বলেন, একসময় দেশের বিভিন্ন নদীতে পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়া যেত। পদ্মার ইলিশ ছিল বড় এবং স্বাদে অনন্য। এখন সেই বড় ইলিশ নেই, স্বাদও নেই। মেঘনা, যমুনা, সুরমা ও কুশিয়ারার মতো নদীতে ইলিশ বাড়লেও পদ্মায় বাড়েনি। এর কারণ, পদ্মার স্বাভাবিক খরস্রোতা বা যৌবন হারিয়ে গেছে। পদ্মায় ইলিশ ফেরাতে হলে এ নদীতে খরস্রোতা বা নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
তিনি বলেন, রাজশাহীর সুলতানগঞ্জ থেকে ৪.৭ কিলোমিটার একটি এলাকা পদ্মা নদী থেকে ভারতের ভেতরে চলে গেছে। ফলে বাংলাদেশের অংশে মা ইলিশ ও জাটকা ধরা বন্ধ থাকলেও ভারতের দিকে তা উন্মুক্ত থাকছে। এজন্য রাজশাহীতে বড় ইলিশ পাওয়া যায় না।
অধ্যাপক ইয়ামিন হোসাইন বলেন, গত কয়েক বছরের গবেষণায় দেখা গেছে, এখন ইলিশের প্রজনন মৌসুমেও (অক্টোবর–নভেম্বর) রাজশাহীর পদ্মায় বড় ইলিশ পাওয়া যায় না। এ কারণে রাজশাহীর ইলিশের ওজন সাধারণত ২০০ থেকে ৩০০ গ্রামের বেশি হয় না। ভারতের সঙ্গে যৌথ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে ইলিশ ফেরানোর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর পবা, চারঘাট, বাঘা ও গোদাগাড়ী এলাকার পদ্মা নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়। চারঘাটে সবচেয়ে বেশি ইলিশ পাওয়া যায়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে চারঘাটে ৩ হাজার ২০০ কেজি ইলিশ ধরা পড়েছে; আগস্টে ২ হাজার ৮৩০ কেজি ও জুলাইয়ে ধরা পড়েছে ১ হাজার ৪৪৬ কেজি ইলিশ। বেশিরভাগ ইলিশ ছোট আকারের হলেও মাঝে মাঝে বড় ইলিশও পাওয়া যায়।
চারঘাটের সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. ওয়ালী উল্লাহ মোল্লাহ টিবিএসকে বলেন, 'আমি এখানে তিন বছর ধরে আছি। তার মধ্যে এ বছর সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়েছে। তবে ইলিশগুলো আকৃতিতে ছোট। পাঁচ থেকে ছয়টা মিলে এক কেজি হয়। বড় ইলিশ ধরা পড়ে মাঝে মাঝে।'
তিনি জানান, আকারভেদে ৩০০ গ্রামের ইলিশ ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা, ৭০০-৮০০ গ্রামের ইলিশ ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা এবং এক কেজি ওজনের ইলিশ ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
তিনি বলেন, এখন ইলিশ সেভাবে নিচু এলাকা থেকে উজানে আসে না। বিশেষত নদীতে পানির গভীরতা কমে যাওয়া, বাঁধ দেওয়া, ফিল্টারেশন বেশি হওয়া ( ড্রেজিংয়ের কারণে পানিতে বালুর পরিমাণ বেড়ে পানি ঘোলা হয়ে যাওয়া) কারণে ইলিশ আসা কমে গেছে। পানির গভীরতা ২০ থেকে ২৫ ফুট না হলে মাছ আসতে চায় না, কিংবা এলেও চলে যায় বলে জানান তিনি।
বাঘা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সাহাদুল ইসলাম জানান, বাঘার পদ্মায় গত এক মাসে প্রায় ১ মেট্রিক টন ইলিশ ধরা পড়েছে, যার বেশিরভাগের ওজন ৩০০-৪০০ গ্রাম। এক কেজি ওজনের ইলিশও পাওয়া গেছে।
রাজশাহী জেলায় জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের আড়াই মাসে চারটি উপজেলায় ৫.৩৭ মেট্রিক টন ইলিশ ধরা পড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৮.৫৫ মেট্রিক টন ইলিশ ধরা পড়লেও পরের বছর থেকে ইলিশ আহরণ কমতে শুরু করে।
রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ইলিশ এমন একটি মাছ যা সমুদ্র ও নদী উভয় জায়গায় বিচরণ করে। ইলিশের যৌবনপ্রাপ্তির জন্য সমুদ্রে বসবাস করতে হয়, আর ডিম দেওয়ার জন্য আসতে হয় নদীতে। কারণ ইলিশ সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে ডিম দিতে পারে না। ডিম দিলেও নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য স্বাদু পানি তার প্রয়োজন। স্বাদু পানিতে ডিম দিলে তা নষ্ট হয় না। এছাড়া যত বেশি উজানে যাবে তত বেশি ডিম থেকে ইলিশ পাওয়ার হারও বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, একসময় পদ্মায় প্রচুর ইলিশ পাওয়া গেলেও পানির গভীরতা কমে যাওয়া, যত্রতত্র ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা, বাঁধ দেওয়া, পানির প্রবাহ কমে যাওয়া, নদীতে ভাটির দিকে অত্যাধুনিক জাল ফেলে মাছ ধরার কারণে রাজশাহীর এলাকায় ইলিশ পাওয়ার হার কমে গেছে। তবে এখন জাটকা সংরক্ষণ প্রকল্প চালু ও মা ইলিশ ধরা বন্ধ থাকায় এ অঞ্চলে ইলিশের পরিমাণ বাড়ছে।
রাজশাহী বিভাগের মধ্যে পাবনার ঈশ্বরদী ও সুজানগর এবং সিরাজগঞ্জের চৌহালী এলাকায় বেশি ইলিশ পাওয়া যায়। সিরাজগঞ্জের চৌহালীতে ইলিশের প্রাচুর্য বেশি।
রাজশাহী বিভাগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫০৭ মেট্রিক টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭৩৫ মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭৪১ মেট্রিক টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৮১ মেট্রিক টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬০০ মেট্রিক টন ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৯২ মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ করা হয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, মা ইলিশ ডিম দেওয়ার জন্য বঙ্গোপসাগর থেকে উজানে আসার পথে বাধাগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে ভাটার শরিয়তপুর, চাঁদপুর ও ভোলা অঞ্চলে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মাছ ধরার কারণে উজান এলাকায় পর্যাপ্ত মা ইলিশ যেতে পারে না। তাই রাজশাহী অঞ্চলে ইলিশ কম পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, 'এবার আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব যাতে আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর এই সময়কালে ভাটা অঞ্চলে কেউ ইলিশ মাছ ধরতে না পারে।'