বিদেশি ঠিকাদারদের শেয়ার নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে বন্ধ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ
আগস্টে ফের শুরু হওয়ার কথা ছিল ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ। কিন্তু শেয়ার নিয়ে বিদেশি ঠিকাদারদের বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় অর্থায়ন-সংক্রান্ত সমস্যায় কাজ এখনও বন্ধ রয়েছে।
এই স্থবির দশা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালের জুনের ডেডলাইনের মধ্যে প্রকল্পটি সম্পন্ন করা সম্ভব হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)।
ঠিকাদার ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেডকে (এফডিইসিএল) অবিলম্বে কাজ শুরু করার আহ্বান জানিয়ে সেতু কর্তৃপক্ষ হুঁশিয়ারি দিয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে জরিমানা করা হবে।
প্রকল্প পরিচালক এএইচএম শাখাওয়াত আখতার বলেন, দ্রুত কাজ শুরু করার জন্য ঠিকাদারকে চাপ দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। 'আমরা তাদের জানিয়ে দিয়েছি ২০২৫ সালের জুনে পর্যন্ত প্রকল্পের যে ডেডলাইন দেওয়া হয়েছে, তা আর বাড়ানো হবে না।'
তিনি জানান, ইতিমধ্যে প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ২৫ শতাংশের কাজ যদি তিনটি শিফটে করা হয়, তাহবে প্রকল্পটি এখনও সময়মতো সম্পন্ন করা সম্ভব। মেয়াদের মধ্যে প্রকল্প সম্পন্ন করতে না পারলে জরিমানা আরোপ করা হবে বলেও জানান তিনি।
২০১১ সালের এপ্রিলের এ প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়। এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৩ শতাংশ অর্থ দিচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি বহন করছে, বাকি ২৭ শতাংশ অর্থায়ন করছে বাংলাদেশ সরকার। প্রথমে এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ইতালথাই ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড গঠন করা হয়েছিল।
কিন্তু অর্থের সংস্থান করতে না পারায় ২০১৯ সালে এক্সিম ব্যাংক অভ চায়না ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অভ চায়না (আইসিবিসি) থেকে ৮৬১ মিলিয়ন ডলার ঋণ জোগাড় করে ইতালথাই। বিনিময়ে চীনের দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না শানদং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ও সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেডের কাছে এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানির যথাক্রমে ৩৪ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি।
তবে পরবর্তীতে ইতালথাই ঋণের একটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে প্রকল্পটির জন্য ঋণছাড় বন্ধ করে দেয় এক্সিম ব্যাংক অভ চায়না ও আইসিবিসি। ঋণছাড় অব্যাহত রাখার জন্য ব্যাংক দুটি ইতালথাইয়ের হাতে থাকা সিংহভাগ শেয়ার দুই চীনা ঠিকাদারের কাছে হস্তান্তরের দাবি জানায়। তখন সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে সালিশি নোটিশ পাঠায় ইতালথাই।
প্রকল্প পরিচালক শাখাওয়াত আখতার জানান, তারা অক্টোবরের শুরুতে নির্ধারিত সালিশি শুনানির ফলাফলের অপেক্ষায় আছেন। তারা আশা করছেন, এ ফলাফলে মাধ্যমে বিরোধের নিষ্পত্তি হবে।
এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভাস্কন খান্নাভার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায়নি। তার অফিস থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, তিনি এখন এ বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক নন। তার ফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে।
এর আগে জুলাইয়ের শুরুতে তিনি বলেছিলেন, প্রতিষ্ঠানটি অর্থের সংস্থান করতে পেরেছে, আগস্টেই ফের নির্মাণকাজ শুরু হবে। কিন্তু সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদও কাজ বন্ধ আছে।
ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানির একজন কর্মকর্তা জানান, অর্থ জোগাড়ের কাজ এগোলেও জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের দ্বিধায় ফেলে দেয়।
আন্দোলনের সময় ১৮ জুলাই বনানী টোল প্লাজায় আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে, এর পরদিন ১৯ জুলাই মহাখালী টোল প্লাজায় হামলা হয়। এতে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ায় বিনিয়োগ আরও বিলম্বিত হয় বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
সেতু কর্তৃপক্ষের জরিমানার হুঁশিয়ারিরও সমালোচনা করেন ওই কর্মকর্তা। বলেন, 'এটি একটি পিপিপি (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব) প্রকল্প। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সবসময় তাদের কাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করার লক্ষ্য রাখে। সরকারও এ প্রকল্পের অংশীদার, তাদের এমন আচরণ করা উচিত নয়।'
এদিকে শেয়ার মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়টি বাংলাদেশের আদালতেও গড়িয়েছে। আপিল বিভাগ ১ সেপ্টেম্বর প্রকল্পের ঠিকাদাদের মধ্যে শেয়ার হস্তান্তরের ওপর স্থগিতাদেশ তুলে নেন।
এর আগে ইতালথাই হাইকোর্টে একটি সালিশি মামলা দায়ের করে। তার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত গত ১২ মে শেয়ার হস্তান্তরের ওপর থাকা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের আদেশ দিয়ে ইতালথাইয়ের আপিল খারিজ করে দেন। ইতালথাই ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল দৈর্ঘ্য ১৯.৭৩ কিলোমিটার। র্যাম্পসহ এর দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ৪৬.৭৩ কিলোমিটার।
২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর এক্সপ্রেসওয়ের প্রথম অংশ উদ্বোধন করা হয়। এর পরদিন দক্ষিণ কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ১১.৫ কিলোমিটার অংশ জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। পরে কারওয়ানবাজার অংশে নামার সংযোগ সড়ক বা ডাউন র্যাম্প খুলে দেওয়া হয় এ বছরের ২০ মার্চ।