রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ ছাড়ের মেয়াদ না বাড়ানোর ইঙ্গিত রাশিয়ার
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ঋণ ছাড়ের মেয়াদ ২ বছর বাড়ানোর যে প্রস্তাব বাংলাদেশ সরকার দিয়েছিলো, রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ সেটি অনুমোদন করতে চাচ্ছে না।
গতকাল (মঙ্গলবার) অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঋণ ছাড়, সুদের অর্থ পরিশোধ নিয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ ঋণ ছাড়ের মেয়াদ না বাড়ানোর এমন ইঙ্গিত দিয়েছে।
ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে এটমট্রএক্সপোর্টের প্রতিনিধি, রাশিয়ান এক্সিম ব্যাংকের প্রতিনিধি, ঠিকাদার সংস্থা রোসাটমের প্রতিনিধি, ঢাকাস্থ রাশিয়ান দূতাবাসের প্রতিনিধি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালি ব্যাংকের প্রতিনিধি এবং রূপপুর প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে উপস্থিত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে জানিয়েছেন, বকেয়া অর্থ পরিশোধ না করা পর্যন্ত অর্থছাড়ের মেয়াদ বাড়াতে অপারগতা জানিয়েছে রাশিয়া। আগামী ডিসেম্বরে অর্থ ছাড়ের মেয়াদ শেষ হবে।
চুক্তি সংশোধন করে মেয়াদ না বাড়ানো হলে, এই প্রকল্পে রাশিয়ার অর্থছাড়ও আটকে যেতে পারে। এ অবস্থায় দুই দেশের সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বা রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা ছাড়া বিষয়টির সমাধান দেখছে না ইআরডি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলার। এর ৯০ শতাংশ বা ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান সরকার ঋণ হিসেবে দিবে। আর ১০ শতাংশ বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন।
চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে এই ঋণ রাশিয়ার ছাড় করার বা বাংলাদেশের নেওয়ার কথা। গত ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ২৫টি কিস্তিতে বাংলাদেশকে ৭.৩৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড় করেছে রাশিয়া। চুক্তি অনুযায়ী ঋণের বাকি ৪.০৫ বিলিয়ন ডলার আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে রাশিয়া ছাড় করবে বা বাংলাদেশকে নিতে হবে।
প্রকল্পের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "প্রকল্পের যে অগ্রগতি তাতে মাত্র তিন মাসে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ নেওয়া সম্ভব হবে না। এজন্য গত জুন মাসেই রাশিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে ঋণ ছাড়ের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করার প্রস্তাব করে চিঠি দেওয়া হয়েছিলো।
জানা গেছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের ৭০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।
ঐ কর্মকর্তা বলেন, "এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য পরিস্থিতিও পরিবর্তন হয়েছে। ফলে রাশিয়ার ছাড় করা অর্থের চলতি ও বকেয়া সুদ বাবদ পাওনা প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়নি। রাশিয়ান পক্ষ এই অর্থ দ্রুত ফেরত চাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে ঋণ পাওয়া, ঋণের সুদ পরিশোধ নিয়ে এক ধরনের টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, "পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনাসহ অন্যান্য টেকনিক্যাল বিষয়ে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষের সম্পৃক্ততা রয়েছে। বর্তমানে ৫ হাজার রাশিয়ান এই প্রকল্পে কাজ করছেন। হঠাৎ করে রাশিয়া অর্থ ছাড় বন্ধ করলে এসব কর্মীদের কী হবে বা ৬ মাস পরে তাদেরকে পুনরায় পাওয়াও যাবে কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ফলে রাশিয়া ঋণ ছাড়ের মেয়াদ বাড়াবে না এমনটা বাংলাদেশ ভাবছে না। তবে ইআরডি রাশিয়ার বক্তব্য এবং প্রকল্পের সামগ্রিক অবস্থা তুলে ধারে সরকারকে অবহিত করবে। বাংলাদেশ ও রাশিয়া উভয় দেশের সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে আলোচনা করে সমাধান করতে হবে।"
ইআরডি সূত্রে জানা যায়, গত ২১ আগস্ট রাশিয়ান সরকারের প্রতিনিধি সংস্থা ভিইবি.আরএফ ব্যাংক এক চিঠিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ইতিমধ্যে ছাড় করা ঋণের বকেয়া ও চলতি সুদ বাবদ ৬৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিশোধ করার অনুরোধ করে।
ব্যাংকটি চিঠিতে ব্যাংক অব চায়নার সাংহাই শাখায় মার্কিন ডলার অথবা চায়না মুদ্রা ইউয়ানে পাওনা অর্থ জমা করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই ব্যাংকটিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ চাইলেও অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না।
চুক্তি অনুযায়ী যতটা ঋণ বিতরণ করা হবে, বিতরণের পরে ষান্মাসিক ভিত্তিতে তার সুদ পরিশোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার সুদ পরিশোধ করে আসছিলো। কিন্তু এই যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ান ব্যাংক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় নিয়মিত অর্থ পরিশোধ সম্ভব হয়নি। সেই থেকে সুদের পাশাপাশি জমতে থাকে জরিমানা সুদও।
সূত্র জানায়, চুক্তি অনুযায়ী এই ঋণের আসল পরিশোধ শুরু হবে ২০২৭ সালের মার্চ থেকে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে সংকট দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এই পরিশোধ শুরুর মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৯ সালের মার্চ থেকে করার প্রস্তাব করেছিলো। গত ২৭ মার্চ ইআরডি এক সভায় এ প্রস্তাব করে। এই প্রস্তাবে প্রথম দিকে রাশিয়ান পক্ষ সম্মত থাকলেও সম্প্রতি তারা নাকচ করে দিয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পটি যে গতিতে এগোনোর কথা ছিল সে অনুযায়ী এগোচ্ছে না। বিশেষ করে এই প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কার্যক্রম ঠিকমতো এগোয়নি। আগামী ডিসেম্বরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। সঞ্চালন লাইন স্থাপন না হলে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। এজন্য সরকার আরও সময় নিয়ে রাশিয়া থেকে ঋণ নিতে চাচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এই ঋণ বিষয়ে রাশিয়ার সাথে লেনদেন করে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড। রাষ্ট্র মালিকানাধীন ওই ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ান পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি এস্ক্রো অ্যাকাউন্ট খুলে রাশিয়ার পাওনা অর্থ জমা রাখা হচ্ছে। ফলে পাওনা পরিশোধ করা কঠিন নয়। এখানে সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে কোন মুদ্রায়, কোন দেশের ব্যাংকে অর্থ পাঠানো হবে।"