অধিক বৃষ্টিপাতে দীর্ঘ বর্ষাকাল, অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনা
বাংলাদেশ সাধারণত জুন থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বর্ষাকাল; এ সময়েই বছরের বেশিরভাগ বৃষ্টিপাত হয়। জুলাইতে হয় সর্বোচ্চ বৃষ্টি, এরপর ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
তবে চলতি বছরের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। এ বছর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরেও হয়েছে নজিরবিহীন বৃষ্টিপাত; দীর্ঘ হয়েছে বর্ষাকাল। আগস্টে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৬ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে ৩৩ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে দেশে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) জানিয়েছে, মৌসুমী বায়ু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় স্থায়ী হতে পারে। অক্টোবরে দেশের পূর্ব-দক্ষিণ অংশে আবারও দেখা দিতে পরে বন্যা; হতে পরে ঘূর্ণিঝড়ও।
কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ে পিএইচডি গবেষক ও আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ টিবিএসকে বলেন, সক্রিয় বর্ষার কারণে বাংলাদেশে মৌসুমের শেষের দিকে রেকর্ড বৃষ্টিপাত হয়েছে।
তিনি বলেন, "মৌসুমি বায়ুর অক্ষ এখন উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ফলে, বৃষ্টিপাত আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।"
এদিকে, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর বুধবার (২ অক্টোবর) জানায়, সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা সৃষ্টি হচ্ছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা, উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং সমুদ্র বন্দরসমূহের উপর দিয়ে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
এজন্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরসমূহকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে অধিদপ্তর।
এছড়া, বুধবার সকাল ৬টা থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেটে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের সতর্কতা জারি করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বিজ্ঞপ্তিতে চট্টগ্রাম বিভাগে ভূমিধসের ঝুঁকি সম্পর্কেও সতর্ক করা হয়।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত দুই মাসে বঙ্গোপসাগরে ছয়টি লঘুচাপ তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে চারটি নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সাগরে সৃষ্ট গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা ৪ অক্টোবরের দিকে লঘুচাপে পরিণত হতে পারে। বিগত কয়েক বছরের সঙ্গে তুলনা করলে এবারের বর্ষা মৌসুমের ব্যপ্তিকাল একটু বেশি এবং শেষ দিকে এসে বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "বর্ষা মৌসুমে জুলাইয়ে বৃষ্টিপাত বেশি থাকে। কিন্তু এবারে জুলাইয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। কিন্তু আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে।"
"অক্টোবরেও সারা দেশে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হতে পারে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিই হতে পারে। তবে মৌসুমের গড় বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের কাছাকাছি রয়েছে," যোগ করেন তিনি।
জলবায়ু পরিবর্তন, মৌসুমী বায়ুর অবস্থানের কারণে এবারের বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তন এবং বারবার লঘুচাপ সৃষ্টি হচ্ছে বলে যুক্ত করেন এই আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের অক্টোবরের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে দেশে স্বাভাবিক অপেক্ষা বেশি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। বঙ্গোপসাগরে ১-৩টি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে, যার মধ্যে ০১টি নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে হতে পারে।
বিগত ১৩৩ বছরের অক্টোবরের তথ্য বিশ্লেষণ করে আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ১৮৯১ থেকে এ পর্যন্ত অক্টোবর মাসে বঙ্গোপসাগরে ৫১টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে, যার মধ্যে অতি প্রবল ছিল ৪৩টি। এরমধ্যে ৮টি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করেছে। আর অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করেছে ১১টি। তাই অক্টোবর মাসে ঘূর্ণিঝড় হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
১৯৬০ সালের ৩১ অক্টোবরের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখ ১৪৯ জন নিহত হন। তখন ৬.১ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। আর এ সময় চট্টগ্রামে হয়েছিল ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস।
সম্প্রতি ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ও ভারতকে প্রভাবিত করে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে দেশের ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, "আগামী তিনদিন সিলেট এবং চট্টগ্রামের প্রধান নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আপাতত বন্যার সম্ভাবনা নেই। কুমিল্লাসহ বেশকিছু স্থানে জলাবদ্ধতা রয়েছে সেখানে বৃষ্টির কারণে পানি বাড়তে পারে। আবহাওয়া পূর্বাভাস অনুযায়ী, বৃষ্টি বৃদ্ধি পেলে চট্টগ্রামের কিছু এলাকা প্লাবিত হতে পারে।"
তবে উত্তারাঞ্চলে বন্যার পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক আছে এবং কোনো নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে নেই বলে যুক্ত করেন তিনি।
আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, "দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে বুধবারই ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে, যা ৬ তারিখ পর্যন্ত থেমে থেমে চলবে। বিশেষ করে, সিলেট এবং চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ওই এলাকায় আবার বন্যা সৃষ্টির প্রবল সম্ভাবনা তৈরি করেছে।"
এছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ভূমিধসের ঘটনা ঘটতে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি।