ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলোর অধিকাংশই কেন এখন প্রায় ‘অকার্যকর’?
বাংলাদেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে তথ্য ও সেবা কেন্দ্র চালু করা হয় প্রান্তিক জনগণকে ডিজিটাল সেবা দেওয়ার জন্য। কিন্তু এক যুগ পরে এসে সেন্টারগুলোর বেশিরভাগেরই প্রায় 'অকার্যকর' দশা হওয়ায় প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গ্রামীণ সমাজ।
ফলে ৬০ ধরনের সেবা প্রদানের কথা থাকলেও জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এসব ডিজিটাল সেন্টার।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর যৌথভাবে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের (ইউডিসি) প্রথম ধাপ উদ্বোধন করেন।
ভোলা জেলার চর কুকরি–মুকরি ইউনিয়ন থেকে শুরু হয় এ যাত্রা। প্রথম দিনই চালু করা হয় ৪ হাজার ৫০১টি ইউডিসি। এসব ইউডিসিতে নিয়োগ করা হয় দুজন করে ব্যক্তি— যাদের একজন নারী ও একজন পুরুষ। তাদেরকে উদ্যোক্তা বলা হয়।
উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, তারা গত ১৪ বছর ধরে চাকরি স্থায়ী হওয়া ছাড়াই কাজ করছেন। তারা সরকারী কোষাগার থেকে কোনো বেতন–ভাতা পান না; এর পরিবর্তে ডিজিটাল সেন্টারগুলোর আয়ের সাথে চুক্তির ভিত্তিতে টাকা পেয়ে থাকেন।
তবে এখন ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্মার্টফোন এবং কম্পিউটার সেবা সহজলভ্য হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ডিজিটাল সেন্টারগুলোতে গ্রাহকদের যাতায়াত কমেছে; ফলে আয়ও কমেছে সেন্টারগুলোর।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রাথমিক পর্যায়ে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার কার্যকরভাবে ফাংশন করেছে। এটির প্রাইমারি উদ্দেশ্য ছিল, ২০২১ সালের মধ্যে প্রান্তিক জনগণকে ডিজিটাল সেবার সঙ্গে পরিচিত করা। বর্তমানে গ্রামেও স্মার্টফোনে ও কম্পিউটার সেবা ব্যক্তি পর্যায়ে এভেইলেবল হওয়ায় সেন্টারগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই সেবা নিতে আসা মানুষের সংখ্যা কমে গেছে।"
তিনি আরও বলেন, "এছাড়া, প্রযুক্তির যে আপগ্রেডেশন (উন্নয়ন) হয়েছে, তাতে ১৪ বছরের পুরনো ডিভাইসের ইউটিলিটি কমে এসেছে। এমনকি, ইউডিসি-র মনিটরিং প্রক্রিয়া গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ এবং অপর্যাপ্ত। তার ওপর উদ্যোক্তাদের সরকারি বেতন–ভাতা নেই। তাই ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলোর কার্যকারিতা কমে গেছে।"
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজশাহীর বাগমারার মাড়িয়া ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে রয়েছে তিনটি কম্পিউটার ও দুটি ল্যাপটপ।
এখানকার উদ্যোক্তা আব্দুল মালেক জানান, "শুরুতে সরকার থেকে আমাদের তিনটি কম্পিউটার ও দুইটি ল্যাপটপ কিনে দেওয়া হয়েছে। বসার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আমাদের একটি কক্ষ দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ বিলও দিতে হয়না। কিন্তু এখন কম্পিউটার থেকে শুরু করে যাবতীয় মেইনটেন্যান্সের কাজ আমাদের করতে হয়।"
"প্রতিটি আবেদনপত্রের জন্য ২০ থেকে ৫০ টাকা ফি নেওয়া হয়। এখান থেকে যা উপার্জন হয়, সেটা দিয়েই কোনোমতে জীবিকা চলে। এছাড়া, সরকারিভাবে আমাদের কোনো ভাতা প্রদান করা হয় না।"
আব্দুল মালেক বলেন, "শুরুতে প্রচুর কাজের চাপ ছিল। এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে কাজের চাপ। কারণ জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্রের অনলাইন কার্যক্রম বেশিরভাগই শেষ হয়ে গেছে। এখন নতুন যেসব শিশু জন্ম নেন, তাদের শুধু জন্ম নিবন্ধন করতে হয়। এছাড়া, বিভিন্ন বয়স্ক ভাতা যেমন— ভিজিএফ, টিসিবি, প্রতিবন্ধি ভাতা, ভিজিডি ভাতা অনলাইন সেবার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এখন আর এসব কাজ নেই। আবার ইউনিয়ন পর্যায়ে ব্যক্তি উদ্যোগে সুযোগ বাড়ার কারণেও অনেকে এখন ইউনিয়ন পর্যায়ে সেবা নিতে কম আসেন।"
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন অনুসারে, 'ইউডিসি এর মূল লক্ষ্য ছিল ইউনিয়ন পরিষদকে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, যাতে এই সব প্রতিষ্ঠান ২০২১ সালের মধ্যে একটি তথ্য ও জ্ঞান-ভিত্তিক দেশ প্রতিষ্ঠায় যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে। এতে প্রায় ৬০ ধরনের সরকারি-বেসরকারি সেবা দেওয়া হবে।'
অনলাইন জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন ছাড়াও ইউডিসির উল্লেখযোগ্য সরকারি সেবাসমূহ হলো— জমির পর্চা, জীবন বীমা, পল্লী বিদ্যুতের বিল পরিশোধ, সরকারি ফরম, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল, অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, ভিজিএফ-ভিজিডি তালিকা, নাগরিক সনদ, নাগরিক আবেদন, কৃষি তথ্য, স্বাস্থ্য পরামর্শ প্রভৃতি।
বেসরকারি সেবাসমূহ হলো— মোবাইল ব্যাংকিং, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ছবি তোলা, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ইমেইল, চাকুরির তথ্য, কম্পোজ, ব্রিটিশ কাউন্সিলের ইংরেজি শিক্ষা, ভিসা আবেদন ও ট্র্যাকিং, ভিডিওতে কনফারেন্সিং, প্রিন্টিং, স্ক্যানিং, ফটোকপি, লেমিনেটিং ইত্যাদি।
মাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল হক জানান, "অন্যান্য ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে কাজ করতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত ফি নেওয়া হয়। তবে আমাদের এখানে সরকার নির্ধারিত ফি অনুযায়ী সেবা দেওয়া হয়ে থাকে।"
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা আরিফুল ইসলাম বলেন, "জেলার নাগরিকদের মধ্যে যারা ইউনিয়ন পরিষদে যান, তাদের বড় একটি অংশের কাজ ছিল জন্ম বা মৃত্যু নিবন্ধন করা। এ কাজের শতকরা ৮০ ভাগ হয় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে। আর আমাদের কাজের ৮০ ভাগ জুড়ে থাকে জন্ম, মৃত্যু নিবন্ধন।"
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ৮ নং শরাফপুর ইউনিয়নে পরিষদের ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে (ইউডিসি) ২০১১ সাল থেকে সেবা প্রদান করছেন বিপ্র দাস কুন্ডু। তিনি বলেন, "ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যে পত্রগুলো দরকার পড়ে, আমরা মূলত সেইগুলো তৈরি করে দেই। পরবর্তীতে চেয়ারম্যান ও সচিব সেটি স্বাক্ষর করে বৈধতা দেন। কিছু কিছু সনদের ক্ষেত্রে সরকারি ফি নির্ধারিত আছে। সেগুলো রাজস্ব হিসেবে জমা হয়। আমরা তার থেকে সামান্য টাকা বেশি নেই, ওই টাকাটা আমি পাই। সরকারিভাবে আমাকে কোনো বেতন দেওয়া হয় না।"
কত টাকা বাড়তি নিয়ে সেবা প্রদান করা হয়— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "একটি জন্ম নিবন্ধন করতে সরকারি ফি ৫০ টাকা নির্ধারিত রয়েছে। তবে আমরা ৭০ টাকা নিয়ে থাকি। বাড়তি ২০ টাকা আমি নিজে পাই। অনুরূপে একটি প্রত্যায়ন লিখে দিয়ে ৩০ টাকা নিই।"
নওগাঁ সদর উপজেলার শৈলগাছী ইউনিয়ন পরিষদের ইউডিসি উদ্যোক্তা সেলিম সরদার বলেন, "অনলাইন-অফলাইনের কয়েকশ ধরনের সেবা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে দেওয়া হয়। এই কাজে সরকারের পক্ষ থেকে ১ টেবিল, একটি ল্যাপটপ, একটি প্রিন্টার আমাদের ইউনিয়ন পরিষদে দেওয়া হয়েছিল। নির্ধারিত ফি-র মাধ্যমে সেবা দেয়া হয়। বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদের সামনে যত্রতত্র ফটোকপির দোকান গড়ে উঠায় আমাদের আয় কমে গেছে। উপার্জিত আয় থেকে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে।"
এদিকে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "৫৫৯১টি ইউডিসি থেকে মাত্র ৮২৩টি সেন্টারে পেনশন স্কিম নিবন্ধন করা যাচ্ছে। এগুলো থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৩২ হাজার ৮০৮ জন ব্যক্তি নিবন্ধন করেছেন। সার্বজনীন পেনশন স্কিম জনগণের দোড়গোড়ায় পৌঁছাতে আমরা ইউডিসিকে কাজে লাগানোর জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম। সেন্টারগুলো সচল থাকলে পেনশন স্কিমের সুবিধা জনগণের নিকট পৌঁছাতে সুবিধা হবে।"
অন্যদিকে, সেবা গ্রহীতারা বিভিন্ন ডিজিটাল সেন্টারে সেবা গ্রহণের সময় হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছেন।
কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের নাজমা আক্তার জানান, তার বড় ছেলে উচ্চশিক্ষার জন্য চীনে যাবে। সব কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকলেও ছেলের জন্ম সনদে তার নাম 'আক্তার' এর পরিবর্তে 'বেগম' লিখে নিবন্ধন হয়েছে।
সমস্যা সমাধানের জন্য, তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে যান এবং ভুল সংশোধনের জন্য ৫০০ টাকা প্রদান করেন।
এরপরে জন্ম নিবন্ধন সংশোধন হয়ে আসলেও তাতে ভুল থেকে যায়। তিনি ইউনিয়ন পরিষদে ফিরে গেলে তাকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
নাজমা বলেন, "পরে, আমি জেনেছি, টাকা নেওয়ার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল করা হয়েছিল।"
এদিকে, স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে কতটি ইউডিসি চালু আছে বা তারা কী ধরনের সেবা দিচ্ছে, তার কোনো হালনাগাদ তথ্য নেই এই মুহূর্তে।
চাকরী স্থায়ীকরণের দাবি
চাকরি স্থায়ীর দাবিতে গত ২১ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহ প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার পরিচালক কল্যাণ সমিতি ঝিনাইদহ জেলা শাখা।
সেখানে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মুজিবুল হক বলেন, "১৪ বছর ধরে ডিজিটাল সেন্টারে নিযুক্ত উদ্যোক্তারা নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে গেলেও চাকরি স্থায়ী হয়নি। নিয়োগের সময় তাদের সরকারি বিধিবিধান মেনে নিয়োগ করা হলেও বেতনের ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারিভাবে তাদের বেতন-ভাতা না দিয়ে জবরদস্তিমূলক শ্রম চুক্তিপত্র দ্বারা আবর্তিত করা হয়েছে।"
তিনি আরো বলেন, "জনগণের কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিতে গেলে অনেক সময় নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এছাড়া ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচালকদের ইচ্ছামতো চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ ২০১৬ সালে গেজেটের মাধ্যমে নতুন পদ সৃষ্টি করে হিসাব সহকারী কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগ দিয়েছেন। ফলে তারা ইউনয়িন ডিজিটাল সেন্টারে কর্মরত পরিচালকদের কাজে হস্তক্ষেপ করছেন। এতে পরিচালকরা নানাভাবে হয়রানি ও ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছেন।"