গণপিটুনি যেকোনো মানুষের জন্য আতঙ্ক ও অনিরাপত্তার কারণ: রেনু হত্যা মামলার পর্যবেক্ষণে আদালত
পাঁচ বছর আগে রাজধানীর বাড্ডায় গণপিটুনিতে রেণু হত্যা মামলায় রায় ঘোষণার সময় আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, গণপিটুনির নামে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেওয়া হলে তা এ সমাজের যেকোনো মানুষের জন্য আতঙ্ক ও অনিরাপত্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এ মামলায় একজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিষয়ে আদালত বলেন, 'একজন মানুষ যখন পশু হয়ে যায়, তখন তার জীবন কেড়ে নেওয়াই শ্রেয়।'
আদালত আরও বলেন, 'অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হলে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে।'
বুধবার (৯ অক্টোবর) ঢাকার ষষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ মুর্শেদ আলম এই রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষনার সময় এই পর্যবেক্ষণ দেন আদালত। রায়ে একজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং চারজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
পর্যবেক্ষণে অঅদালত বলেন, একজন স্বামী পরিত্যক্তা নারী রেনু বেগমকে নির্মমভাবে, মধ্যযুগীয় কায়দায় পিটিয়ে হত্যা করে আসামিরা পশু মনোবৃত্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
৪০ বছর বয়সি রেনু দুই সন্তানের মা ছিলেন। ২০১৯ সালের ২০ জুলাই সকালে ঢাকার উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে শিশু অপহরণকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। রেনু তার চার বছর বয়সি মেয়ে তাহসিন তুবার ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে ওই স্কুলে গিয়েছিলেন।
বুধবার বেলা ১১টা ১০ মিনিটে আদালত এ হত্যা মামলার রায় পড়া শুরু করেন। শুরুতে বিচারক বলেন, 'এটা একটা চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা। টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। ভাগ্যক্রমে আমিই রায় পড়ছি।'
আদালত বলেন, এ মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলামাত ভিডিও ফুটেজ। 'এটা না থাকলে রায়ের দিকে যাওয়া কঠিন হতো। চারটি ভিডিও ক্লিপ আছে। আমি এগুলো দেখাতে চাই।'
পরে আদালত পাঁচ মিনিট করে দুটি ভিডিও ক্লিপ দেখান। ভিডিও দেখে আদালতে কাঁদতে দেখা যায় রেনুর বোন নাজমুন নাহার নাজমাকে।
এর মাঝে বিচারক বলেন, 'আবুল কালাম (রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত) কে?' তখন হাত তোলেন কাঠগড়ায় থাকা আসামি আবুল কালাম।
তার উদ্দেশে বিচারক বলেন, 'আপনি দেখেন তো কী করছেন।' কামাল বলেন, 'আমি সবাইকে বলেছি, থামো। দয়া করে থামো। শোনো সে কী বলতে চায়। আমরা শুনতে চাই। কিন্তু কেউ শোনেনি।'
এরপর বিচারক বলেন, তদন্তে কিছু দুর্বলতা আছে।
আসামি ইব্রাহিমকে (মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি) উদ্দেশ করে বিচারক বলেন, 'দেখ তোমাকে চিনতে পারো কি না।'
ভিডিও দেখা শেষ হলে বিচারক বলেন, 'বেশিরভাগই একজনকে মেরেছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে, সন্দেহ নেই।'
রায় পড়ার সময় বিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেন, 'কেস ডায়েরি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আসামিরা আইন-কানুনের পরোয়া করেননি। আসামি ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লা লাঠি দিয়ে নিহতের দুই হাতে, কাঁধে, বুকে, উরু ও পায়েসহ বিভিন্ন জায়গায় নির্দয় ও নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করেন এবং মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে আঘাত করতে থাকেন।
'রেনুকে হত্যা বীভৎস, নারকীয় ও নৃশংস ঘটনা ছিল। যেভাবে গণপিটুনি দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে, তা মধ্যযুগীয় বর্বরতা এবং সমাজের প্রত্যেক মানুষের জন্য এটি আতঙ্কের।'
বিচারক বলেন, 'আসামি ইব্রাহিম কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া নিষ্ঠুর ও বর্বরভাবে আঘাত করে একজন স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাকে হত্যা করেছেন এবং দুই শিশুকে মাতৃহারা করেছেন। নিজের পশু মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
'তার পূর্ব অপরাধ ও শাস্তির রেকর্ড নেই, কিন্তু নিহতকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করায় তাকে লঘু শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই।'
বিচারক আরও বলেন, 'অপরাধ সংঘটনের সময় তিনি যে নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, উন্মত্ততা ও পৈশাচিকতা প্রদর্শন করেছেন, সেক্ষেত্রে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া সমীচীন হবে না। সংঘটিত আপরাধের মাধ্যমে তিনি নিজেকে সমাজে কলঙ্কিত করেছেন।'
রায়ে ইব্রাহিমকে মৃত্যুদণ্ড এবং রিয়া বেগম ময়না, আবুল কালাম আজাদ, কামাল হোসেন ও আসাদুল ইসলামকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
আসামি ইব্রাহিমকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয় এবং অন্যরা জামিনে থেকে আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায়ের পর তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
২০১৯ সালে এ ঘটনার পর পুলিশ গণপিটুনির ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে।
রেনুকে ছেলেধরা বলে গণপিটুনিতে উসকানি দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের একজন রিয়া খাতুন (৩৫)। ফুটেজে ইব্রাহিম হোসেন হৃদয়কে রেনুর ওপর আক্রমণে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়, এমনকি রেনুর প্রায় নিস্তেজ দেহেও তিনি মারতে থাকেন।
ঘটনার পর রেনুর ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন বাড্ডা থানায় ৪০০-৫০০ অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। রেনু লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার বাসিন্দা ছিলেন। ঘটনার সময় তিনি দুই সন্তানসহ ঢাকার মহাখালীতে বসবাস করছিলেন। দুই বছর আগে স্বামীর সঙ্গে তার বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল।