বন্যায় চালের উৎপাদনে ক্ষতি ১০.৮৭ লাখ টন, চলছে সরকারি-বেসরকারি আমদানির প্রক্রিয়া
আগস্টে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে চলমান বন্যার প্রভাবে ১০.৮৭ লাখ টন চালের উৎপাদন নষ্ট হয়েছে বলে উঠে এসেছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদনে।
এই অবস্থায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারিভাবে ৫ লাখ টন চাল আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। একইসঙ্গে, বেসরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমতি দেওয়ার আগে শুল্ক কমানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। গত মাস থেকে চালের দাম ইতোমধ্যেই কেজিতে ৫ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, চালের সঙ্গে অন্তত ২ লাখ টন সবজি এবং কাচাঁমরিচ-সহ আরও কিছু ফসলের উৎপাদন নষ্ট হয়েছে। দুই দফার বন্যায় এখন পর্যন্ত যে ফসলের ক্ষতি হয়েছে, তা টাকার অংকে ৪,৫০০ কোটি টাকা।
দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের বন্যা শুরু হয় গত আগস্টের মাঝামাঝিতে। এই বন্যায় আমন আবাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই পরিস্থিতিতে চালের দাম একটু একটু করে বাড়াতে শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। কদিন ধরেই আবার অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয় ময়মনসিংহের শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলায়— যা এখনো চলমান। এই বন্যা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা এখন পর্যন্ত দুই-তিন ধাপে অন্তত ৫-৬ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছেন চালের দাম।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, সরকারের কাছে বর্তমানে প্রায় ১২.১৬ লাখ টন চাল এবং ৪.৬৯ লাখ টন গমের মজুদ রয়েছে।
তবে, চালের মজুদ ধীরে ধীরে কমে আসছে, কারণ এই চাল থেকেই সরকার প্রতিমাসে এক কোটি পরিবারকে ওএমএস প্রোগ্রামের অধীনে ভর্তুকি মূল্যে চাল বিতরণ করছে।
তাই আসন্ন ঘাটতি এবং মূল্যবৃদ্ধির চাপ মোকবেলায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় খাদ্য মন্ত্রণালয়কে জি–টু–জি ভিত্তিতে চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) পাঠানো মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বেসরকারিভাবে আমদানির জন্য চাল আমদানিতে থাকা ৬২.৫০ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ৫ শতাংশ করার অনুরোধ জানানো হয়।
এনবিআরকে পাঠানো চিঠিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, দেশের ১৪টি জেলার ভয়াবহ বন্যায় আউশ, আমনের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় চালের মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য স্থিতিশীল রাখতে সরকারি নিরাপত্তা মজুদ গড়ে তোলার স্বার্থে সরকারিভাবে আমদানির প্রয়োজন। একইসঙ্গে সারাদেশের সরবরাহ নিশ্চিত করতে বেসরকারিভাবেও চাল আমদানি প্রয়োজন।
তবে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম স্থানীয় বাজারের তুলনায় বেশি। যে কারণে চাল আমদানি করতে হলে বিদ্যমান আমদানি শুল্ক কমানো প্রয়োজন; তা না হলে বেসরকারি আমদানি উৎসাহিত করা যাবে না।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাসুদুল হাসান টিবিএসকে বলেন, "চাল আমদানির শুল্ক কমানোর জন্য এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো শুল্ক কমানোর কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি এনবিআর।"
তিনি বলেন, "আমরা সরকারিভাবে ৫ লাখ টন চাল আমাদনির প্রক্রিয়া শুরু করেছি। বেসরকারিভাবেও আমদানির চিন্তা করছি, তবে কত আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে, সেটা এখনও নির্ধারণ হয়নি।"
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান টিবিএসকে বলেন, চালের বাজারে বর্তমান অস্থিরতার কারণে, কিছু ভোক্তা গমের দিকে ঝুঁকছেন, কারণ গমের ময়দা সস্তা।
"যেহেতু আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কম, তাই সরকারের উচিত হবে চাল সরবরাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি গম আমদানিও বাড়ানো," বলেন তিনি।
দাম বৃদ্ধি নিয়ে ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরা যা বলছেন
ঢাকার রামপুরার বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "বিআর–২৮ চালের ৫০ কেজির বস্তা দুইমাস আগে কিনেছি ২,৬৫০ টাকায়— যেটা এখন কিনলাম ৩,০০০ টাকায়। অর্থাৎ, প্রতি বস্তায় ২৫০ টাকা বাড়তি দাম। এই চাল যদি ৫-১০ কেজি কিনি, তাহলে কিন্তু আরও ১-২ টাকা বেশি লাগবে।"
একইভাবে মাঝারি মানের চিকন যে চালগুলো আগে ৬৪-৬৫ টাকায় বিক্রি হতো, সেগুলো এখন ৭০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। মোটা চালের কেজিও এখন অন্তত ৫৫-৫৬ টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা টিসিবি বলছে, গত বছরের তুলনায় এখন মোটা চালের দাম ৭.১৪ শতাংশ বেশি।
আর সবচেয়ে ভালো মানের চিকন চাল কিনতে হলে খরচ করতে হচ্ছে ৮০ টাকা বা তারও বেশি— যা আগে ছিল ৭৫ টাকার মধ্যে।
ভোক্তাদের অভিযোগ, বন্যায় চালের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জেনেই ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়ানো শুরু করেছেন। কিন্তু ব্যবসায়ীরা দিচ্ছেন ভিন্ন যুক্তি।
নওগাঁ ধান-চাল আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা টিবিএসকে বলেন, "এখন বোরো মৌসুমের ধানের মজুত শেষের দিকে। কৃষকের কাছে ধান না থাকায় হাটেও সেভাবে ধান উঠছে না। যে কারণে সরবরাহে ঘাটতি আছে এবং দামও বাড়ছে।"
গত দেড় মাসের ব্যবধানে মাঝারি চাল প্রতিকেজিতে ৩ টাকা বেড়েছে আড়তে। আর চিকন চালের দাম কিছুটা বেড়ে আড়তে ৬৮-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এবারে আমনের বড় ক্ষতি হয়েছে। কাঙ্খিত উৎপাদন পাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই পরিস্থিতি বুঝেই ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য থেকে জানা গেছে, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যায় ৭ লাখ ৯১ হাজার মেট্রিক টনের বেশি চালের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ১ লাখ মেট্রিক টনের কিছু বেশি আউশ এবং বাকিটা আমনের উৎপাদন। ময়মনসিংহের ৪ জেলায় এখন পর্যন্ত ২ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন চালের উৎপাদন নষ্ট হয়েছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, এ বছর ধান উৎপাদনে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না।
তিনি বলেন, "বন্যায় অনেক এলাকায় আমন রোপণ বিঘ্নিত হয়েছে এবং দেরিতে রোপণের ফলে কিছু অঞ্চলে উৎপাদন কমে যাবে।"
ময়মনসিংহে বন্যার প্রভাব আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা
ময়মনসিংহে আকস্মিক বন্যার ক্ষয়ক্ষতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চার জেলার অন্তত ৩০টি উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
আক্রান্ত ৪ জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শেরপুরে। শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলায় ২৩,২৫৩ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এবং সে লক্ষ্যমাত্রা পূরণও হয়েছে। কিন্তু বন্যায় ১৫,১০০ হেক্টর জমির আমন ফসল নষ্ট হয়ে গেছে— যেখানে ৬৯,৭৬২ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হতো বলে জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় এবারে সারাদেশে ৫৯.৬৬৮ লাখ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু বন্যা কবলিত দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২৩ এবং ময়মনসিয়হের ৪ জেলায় গড়ে ১৪.৫০ শতাংশ হারে এই আবাদ একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "আমরা দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের কৃষকদের জন্য নতুন করে ধানের বীজতলা তৈরি করেছি, বিনামূল্যে সার ও নগদ টাকা বিতরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখানে ১৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় এখনো পানি না নামায় এই চারা লাগানো যাচ্ছে না।"
তিনি বলেন, "ময়মনসিংহের বন্যায় যেসব এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হলো, সেখানে আর আমন রোপণের সময় নেই। এখন পানি নামলে অন্য ফসল রোপণের চিন্তা করতে হবে।"
সংকট যে শুধু চালে– তাই নয়, সংকট তৈরি হয়েছে সবজিতেও। ঢাকার বাজারে এখন ৮০-১০০ টাকার কমে কোনো সবজি নেই। কোনো কোনো সবজি কিনতে ১২০-১৫০ টাকাও লাগছে।
কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতা মোহম্মদ আজাদ বলেন, "স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কারওয়ান বাজারে সবিজির ট্রাক ৫০ শতাংশ কম প্রবেশ করছে। পণ্য আসছে কম, কিন্তু পাইকারি ক্রেতা বেশি— তাই দাম বেড়ে যাচ্ছে।"