২,২২৫ কোটি টাকার বাজার: মুরগির খামার যেভাবে জীবনযাত্রা বদলে দিচ্ছে জয়পুরহাটে
গত ১৯ বছর ধরে বাড়ির উঠানে সোনালী মুরগির খামার চালাচ্ছেন জয়পুরহাট সদর উপজেলার সাবিনা খাতুন। তার দুটি খামারে মাংস উৎপাদনকারী সোনালী জাতের মুরগির সংখ্যা ৬,০০০।
স্বামী আব্দুল লতিফ বাইরে কৃষিকাজের পাশাপাশি তাকে সহযোগিতা করলেও মুরগির ব্যবসা মূলত সাবিনা নিজেই পরিচালনা করেন।
শুরুতে অল্প সংখ্যক মুরগি নিয়ে ছোট পরিসরে খামার শুরু করেন সাবিনা। ধীরে ধীরে তার খামার বড় হতে থাকে। এক থেকে দেড় মাস পরপর মুরগি বিক্রি করেন তিনি। এখান থেকে মাসে ৭৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় হয় তার। এই আয় দিয়েই এখন দুই মেয়েকে শহরে রেখে পড়াশোনা করাচ্ছেন।
সাবিনা জানান, গ্রামীণ নারীদের জন্য মুরগী পালন অসাধারণ এক কাজ। ঘরের কাজের পাশাপাশিই এই ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া যায়।
পোল্ট্রি খাতে জেলার অন্তত ২ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে— যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী।
২০০০ সালের পর মূলত জয়পুরহাটে পোল্ট্রি বিপ্লব ঘটে। এরপর থেকেই জামালগঞ্জের অধিকাংশ বাড়িতে মুরগি পালন শুরু হয়। এটিই এলাকার অর্থনৈতিক গতিপথ বদলে দিয়েছে।
জেলা প্রাণীসম্পদ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জয়পুরহাটে মাংস উৎপাদনের জন্য মুরগির খামার রয়েছে ৭ হাজার ৩৪০টি; মুরগি রয়েছে প্রায় পৌনে ২ কোটির উপরে।
এসব মুরগি থেকে ৮৯ হাজার টন মাংস উৎপাদন হয়। জেলায় চাহিদা রয়েছে ৪২ হাজার টনের। ৪৭ হাজার টন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হয়। অর্থাৎ, চাহিদার দ্বিগুণ মাংস উৎপাদন হয় এখানে– যার বাজারমূল্য ২ হাজার ২২৫ কোটি টাকার উপরে।
বাচ্চা উৎপাদনের জন্য হ্যাচারি আছে ৪৭টি। বছরে প্রায় ২ কোটি পিসের উপরে বাচ্চা উৎপাদন হয় এখানে।
জয়পুরহাটের আরেকও ব্যবসায়ী জামালগঞ্জ এলাকার বেলাল হোসেন।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির পাশাপাশি ২০১২ সালে বাড়ির আঙিনায় মুরগি পালন শুরু করেন তিনি। মাত্র ৪ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে ৩৫০ পিস সোনালি মুরগি নিয়ে শুরু হয় তার যাত্রা। মুরগি দেখাশোনা করতেন তার মা। দেড় মাসে সাড়ে ১৭ হাজার টাকা লাভে মুরগিগুলো বিক্রি করেন; এরপরই এই ব্যবসায় আগ্রহ বেড়ে যায়।
পরবর্তীতে ১ হাজার মুরগি পালনের উদ্যোগ নেন বেলাল। সেখানেও ভালো লাভ পান। বড় হতে থাকে পুঁজি। ছেড়ে দেন চাকরি।
২০১৮ সালে এসে বেলালের খামারসঙ্গী হন তার স্ত্রী জান্নাতুন ফৌরদৌস। এখন তাদের তিনটি খামারে মুরগির সংখ্যা কয়েক হাজার। মূলধনও দেড় কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
বেলাল জানান, এখন তিনি মুরগির পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে ভূট্টা, ডিম ও মুরগির বাচ্চার ব্যবসা করেন। ব্যবসায়ের আয় দিয়ে ২০১৯ সালে এলাকায় ১৩ শতক জমিও কিনেছেন। ছোট ভাইকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করিয়েছেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে মুরগীর ব্যবসায় ১০০ মানুষের কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা করছেন।
এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য বেলালের স্ত্রী জান্নাতুনও তার সাথে রয়েছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া জান্নাতুন জানান, "আমাদের বাড়ির আঙিনাতেও একটি খামার আছে। এলাকার প্রায় সব বাড়িতেই মুরগি পালন করা হয়।"
স্বামীকে সাথে তিনি মুরগীর পাশাপাশি গরুর খামার করতে চান। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ আর সহযোগিতায় এই শিল্পকে তারা অনেক দূরে নেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।
জয়পুরহাট-ভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা জাকস ফাউন্ডেশন, এই পোল্ট্রি ব্যবসায়ের উন্নয়নে ব্যাপক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
নানামুখী উদ্যোগ নিয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জাকস- রুরাল মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্টের (আরএমটিপি) মাধ্যমে মুরগি পালনের সাথে জড়িত ১০ হাজার মানুষের সাথে সরাসরি যুক্ত হয়ে কাজ করছে।
এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ), পল্লীকর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও ডেনিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ডানিডা)।
জয়পুরহাটে পোল্ট্রি সেক্টরের টেকসই উন্নয়নে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জাকসের নির্বাহী পরিচালক মো. নূরুল আমিন বলেন, "দাতাগোষ্ঠীর সহযোগিতায় নিরাপদ মাংস উৎপাদনের চাষীদের প্রশিক্ষণ, উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তিবান্ধন কৃষি ব্যবস্থাপনা এবং খামারিদের সাথে সরাসরি বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে বাজার সংযোগ তৈরিতে আমরা কাজ করছি। এতে চাষীরা লাভবান হচ্ছেন। ভোক্তা পর্যায়েও নিরাপদ পণ্য পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।"
স্থানীয় সংস্থা জাকসের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ পেয়ে লাইভস্টক সার্ভিস প্রভাইডার (এলএসপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জয়পুরহাট সদরের মাহবুবুর রহমান রাইহান। আগে তিনি কাঠের দোকানে কাজ করতেন।
রাইহান বলেন, ২০১৮ সাল থেকে সদর ও আক্কেপুরে প্রায় ৫০টি খামারে চিকিৎসা করেন তিনি। এখন দিনে ১ থেকে দেড় হাজার টাকা আয় হয়। জেলায় তার মতো আরও অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
প্রযুক্তিনির্ভর খামার, নিরাপদ মাংস
পিকেএসএফের তথ্য বলছে— দেশের জয়পুরহাট, বগুড়া, নওগাঁ, রংপুর, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, শরিয়তপুর, ফরিদপুর, কক্সবাজারসহ ১২টি জেলায় এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৮৬,৫৫৫ জন মানুষকে সেবার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
আরএমটিপি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ সম্পর্কিত উদ্যোগগুলোর জন্য মানসম্মত সেবা, উপকরণ এবং প্রযুক্তি সহজলভ্য করতে কাজ চলছে। উৎপাদিত পণ্যের ট্রেসেবিলিটি, উৎপাদনশীলতাসহ একাধিক কাজ করছে এই প্রতিষ্ঠান। এতে আয় বাড়ছে সাধারণ মানুষের। উন্নয়ন ঘটছে জীবনমানের।
বর্তমানে আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনা খুব জরুরি বলে মনে করেন সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা সৈয়দ সামসুল এনাম। তিনি বলেন, এখন গরমকালে দেশের তাপমাত্রা খুব বেশি থাকে। এই আবাহওয়ায় মুরগি মরে যায়। এ কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় তিনি তার খামারের ছাদে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্প্রিঙ্কলার (ঝর্নার মতো পানি স্প্রে) প্রযুক্তি স্থাপন করেছেন। এতে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে অটোমেশিন চালু হয়। নির্দিষ্ট তাপমাত্রার পর আবার বন্ধ হয়ে যায়।
"ফলে মুরগি স্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে। মরছে কম। খাবার খাচ্ছে ঠিকমতো," বলেন তিনি।
পিকেএসএফের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল কাদের বলেন, "আমরা চাই নিরাপদ উপায়ে উৎপাদিত মাংস কিংবা খাদ্য আপামর জনতার মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক। দেশে নিরাপদ ব্র্যান্ড গড়ে উঠুক, যা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। যেখানে জনগণ বিশ্বাস করবে, এখানে এই মাংস নিরাপদ। এই নিরাপদ পণ্যের জন্য আমরা খামারি, উদ্যোক্তা কিংবা চাষীদের বিভিন্ন রকমের সার্পোট দিচ্ছি।"
তিনি বলেন, "দেশে বহুমাত্রিক ভেজালের ভিড়ে আশানুরূপ একটি পরিবর্তন আসুক নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে; যা হবে সাসটেইনেবল এগ্রিকালচার সিস্টেম।"
কৃষকরা বলছেন, বর্তমানে তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি কারিগরি, প্রযুক্তি ও বিপণনের সহায়তা পাচ্ছেন। আধুনিক চিকিৎসার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে নিরাপদ উপায়ে মাংস উৎপাদন সহজ হচ্ছে। নিরাপদ মাংস ও খামার করতে আগ্রহী হচ্ছেন চাষীরা।
জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ এলাকায় মঞ্জুরুল আলম রিকোর খামারে প্রায় ১০ হাজার মুরগি রয়েছে। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে এসব মুরগি দেখাশোনা করেন আনিছুর রহমান।
তিনি জানান, "আগে খামার করা খুব কঠিন ছিল। হঠাৎ করেই মরক (রোগ) এসে খামার শেষ করে দিত। এখন মুরগির চিকিৎসার জন্য ডাক্তার আছে। মুরগিতে সহজে মরক লাগে না।"
জয়পুরহাটে মুরগি পালনের ভবিষ্যৎ
সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় অনেকটা নিরাপদ মাংস উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে চাষীরা। এসব মাংস প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করা হচ্ছে।
এসব মাংসের চাহিদাও বেশ ভালো বলে জানিয়ে গ্রিন হারভেস্ট মিটের ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম বলেন, "আমরা নির্দিষ্ট ৬০ থেকে ৭০ জন খামারির কাছ থেকে মুরগি কিনি। কারণ তারা উত্তম কৃষি চর্চার অনুশীলন করে মুরগী পালন করেন। এই মাংসের চাহিদা বেশি। এই কাজের মাধ্যমে এলাকায় নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে।"
খামারি মঞ্জুরুল আলম রিকো জানান, বর্তমান বাজারে ডিমের দাম ভালো। কিন্তু মাংসের দামে কিছুটা সংকট আছে। কারণ এখন খাদ্য, ওষুধ ও বিদ্যুৎ বিলের খরচের তুলনায় মাংসের দাম কম।
তবে এর মধ্যেও চাষীরা আধুনিক উপায়ে নিরাপদ পদ্ধতিতে মুরগি পালনে আগ্রহী হচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মহির উদ্দিন বলেন, "সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কর্মসূচির ফলে এখানকার চাষীরা এখন অপ্রয়োজনীয় কিংবা কম অ্যান্টিবায়েটিক ব্যবহার করছেন। খামারিদের রোগবালাইমুক্ত মুরগি উৎপাদনে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আর এই উদ্যোগগুলো চলমান থাকা দরকার।"