ছেঁউড়িয়ায় লালন উৎসব শেষ হলেও চলছে গ্রামীণ মেলা
লালন শাহ'র ১৩৪ তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় গত বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) শুরু হয় দুদিনব্যাপী লালন স্মরণ উৎসব। পরদিন শুক্রবার বিকেলে উৎসব শেষ হওয়ার পর নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরতে শুরু করেন ভক্ত-অনুসারীরা।
এদিকে উৎসব ঘিরে লালনের আখড়াবাড়ি প্রাঙ্গণে বসেছে গ্রামীণ মেলা। উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা গতকাল শেষ হলেও আজ শনিবারেও মেলা চলছে। এছাড়াও আজ লালন সঙ্গীত অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
আজ শনিবার সরেজমিনে ছেঁউড়িয়ায় আখড়াবাড়ি প্রাঙ্গনে দেখা গেছে, উৎসবকে ঘিরে কালিগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে গ্রামীণ মেলা। রকমারি খাবারের দোকানের পাশাপাশি বসেছে জামা-কাপড়, বেবি ড্রেস, বাচ্চাদের বাহারি খেলনা, শীতের কম্বল, ফার্নিচারসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের স্টল। শিশুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে নাগরদোলা।
ধামরাই থেকে লালন মেলায় আসা রফিক নামের এক কম্বল দোকানি বলেন, প্রতিবারই লালন মেলায় আসি। এবার মানুষ বেশি, তাই ব্যবসাও মোটামুটি ভালো হচ্ছে। শীতের ভাব বেশি হলে বিক্রি আরও বাড়ত।
শহিদুল নামের এক ফার্নিচার দোকানের মালিক বলেন, মেলা চলাকালীন তিনদিন আমাদের বিক্রি হয় না। মেলার সময় মানুষ দেখে যায়, মেলা শেষে আমরা মাসখানেক থাকি। মেলার পরের দিন থেকে আমাদের ব্যবসা শুরু হয়।
পরিবার নিয়ে মেলায় এসেছেন হাসান নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, মেলায় ঘুরতে এসেছি, গরম জিলাপি খাবো, বাচ্চার জন্য খেলনা কিনব। আরিফুল নামের আরেকজন বলেন, মেলা থেকে ছেলের জন্য চশমা ও ঘড়ি কিনলাম।
প্রতিবারের মতো এবারও উৎসব ঘিরে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ভক্ত-অনুসারী ও দর্শনার্থীরা আখড়াবাড়িতে আসেন। তাদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে ছেঁউড়িয়ায় লালনের আখড়াবাড়ি।
বাউল-সাধুরা জানান, প্রতিবছরই উৎসব ঘিরে বহু মানুষ আসেন। তবে এবারের মতো জনস্রোত গত দুই দশকে দেখা যায়নি। আখড়াবাড়ি ছাড়িয়ে মানুষ রাত কাটিয়েছে এক কিলোমিটার দূরে গড়াই নদের পাড়ে। রাত যত বেড়েছে, মানুষের জমায়েত তত বেড়েছে। আখড়াবাড়ির দুই দিকের সড়কের এক কিলোমিটার আগে থেকে কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে দেয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
শুক্রবার ভোরে গোষ্ঠগানের মধ্য দিয়ে বাউলদের আচার শুরু হয়। দ্বিতীয় দিন সকালে 'বাল্যসেবা'। এ পর্বে সকালে অনেক বাউল 'ভেক গ্রহণ' করেন। পায়েস মুড়ি খেয়ে গান-বাজনাতত্ত্ব আলোচনা চলতে থাকে। দুপুরে হয় 'পূর্ণসেবা'। সাদা ভাত, মাছ, কলাইয়ের ডাল, সবজি ও দই। বিকেল থেকে শুরু হয় গান পরিবেশন। এর আগের দিনটিতেও সারারাত চলে সঙ্গীত অনুষ্ঠান।
কয়েকজন বাউল বলেন, আত্মার সম্মিলন সবকিছু শেষ করে যখন চলে যেতে হয়, তখনও তৃষ্ণা থেকেই যায়।
শুক্রবার সরেজমিনে দেখা গেছে, পুরো আখড়াবাড়িতে যেন তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধু, বাউল, লালনভক্ত-অনুসারীদের গান, আলোচনা আর ভাব বিনিময়ে আখড়াবাড়ি প্রাঙ্গণজুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ। লালন একাডেমির প্রবেশপথ, লালন শাহ'র মাজার প্রাঙ্গণ, আখড়াবাড়ি, মেলার মাঠ সর্বত্র ছিল লোকে লোকারণ্য। আখড়াবাড়ির ভেতরে দেখা যায়, হাজার হাজার বাউল ও লালন অনুসারী সাদা কাপড় পরা। অন্য পোশাকেও আছেন অনেকে।
গতকাল দুপুরে আয়োজকদের পক্ষ থেকে তাদের পুণ্যসেবার ভাত, ডাল, সবজি ও ইলিশ খেতে দেওয়া হয়। রীতি অনুযায়ী সাধু-গুরুরা সবাই একসঙ্গে দুপুরের খাবার গ্রহণ করেন।
প্রবীণ সাধক নহির শাহ বলেন, 'বিভিন্ন মতের মানুষ একত্র হয়ে একমতে চলার নাম সাধুসঙ্গ। সেখানে সাধু-গুরুরা একই সুর, একই তাল, একই ভাবে সাধুসঙ্গে অংশ নেন।'
বগুরা থেকে আখড়াবাড়ি আসা আবুল কালাম বলেন, 'বছরে দুবার আখড়াবাড়ির সাধুসঙ্গে আসার সুযোগ হয় আমাদের। এ সময়ে বহু মানুষের সঙ্গে আমাদের মতের লেনাদেনা চলে। খোঁজ করি মনের মানুষের। আবারও ফিরে আসতে চাই এই আখড়াবাড়িতে।
রাজশাহী থেকে আসা কলেজছাত্র সৈকত আহমেদ বলেন, লালনের বাণী ও গান ধর্ম, বর্ণ, জাতির ঊর্ধ্বে। তাই মায়ার টানে আখড়াবাড়িতে এসেছি। অতীতের তুলনায় এবার ভিড় বেশি।
মুসলিমা খাতুন নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, 'সাঁইজি সবসময় মানুষকে ভালো পথে আনা ও ভালোবাসার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমেই স্রষ্টা পর্যন্ত পৌঁছানো যায়।'
গতকাল শুক্রবার অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোছা. শারমিন আখতারের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। বিশেষ অতিথি ছিলেন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, কুষ্টিয়া জজ কোর্টের সাবেক পিপি বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মহম্মদ, ছাত্র প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান, তৌকির আহমেদ প্রমুখ।
উল্লেখ্য, ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর ফকির লালন শাহ মারা যান। এরপর থেকেই দিনটি তার তিরোধান দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।