মধ্যপাড়ার পাথর এখন বিক্রি করাও কঠিন!
দেশের একমাত্র শিলাখনি মধ্যপাড়ায় আছে সব ধরনের লজিস্টিকস — ১.২ বর্গকিলোমিটার খনি থেকে দৈনিক সাড়ে পাঁচ হাজার টন নির্মাণকাজের উপযোগী গ্রানাইট পাথর উত্তোলন করতে সক্ষম খনি পরিচালক সংস্থা, নিজস্ব বিতরণকারী, নিশ্চিত বাজার এবং এমনকী খনি এলাকাকে জাতীয় রেলপথের সাথে সংযুক্ত করতে ১৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নিজস্ব রেল ট্র্যাক।
তবু আমদানি করা পাথরের দামের সাথে প্রতিযোগিতায় না পেরে রাষ্ট্রায়ত্ত খনিটি পাথর বিক্রি করতে পারছে না। নির্মাণশিল্পের ব্যাপক বিকাশের হাত ধরে গ্রানাইটের স্থানীয় বাজার বার্ষিক ২৫-৩০ শতাংশ হারে বেড়ে ৬ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছালেও — মধ্যপাড়া খনি থেকে উত্তোলন করা কঠিন শিলার স্তূপই কেবল বাড়ছে বিক্রিতে ধসের কারণে।
দেশে পাথরের চাহিদার ৬ শতাংশ মেটানোর সক্ষমতা থাকার পরেও — গতবছর নিজস্ব উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশই বিক্রি করতে পারেনি খনি কর্তৃপক্ষ।
দিনাজপুরের মধ্যপাড়া কঠিন শিলা পাথর খনিতে বিক্রির অভাবে ১০ লাখ টনের বেশি পাথর মজুদ রয়েছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য ৩০০ কোটি টাকা। কিন্তু, এর বদলে বাজারে সহজলভ্য ও সস্তা ভারতীয় পাথরই কিনছে ক্রেতারা।
কোম্পানির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান যে, পাথর বিক্রি না হওয়ার কারণে ঋণ করে খনির ঠিকাদারের বিল এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হচ্ছে। গত মাসে ৩০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পাওনা শোধ করা হয়েছে।
ব্যর্থতার নেপথ্যে কারণ
জটিল বিপণন ব্যবস্থা, উচ্চ পরিবহন ব্যয় এবং সরকারি খাতের প্রধান গ্রাহকদের – বেসরকারি পাথর সরবরাহকারীদের কাছে হারানোকে – মধ্যপাড়ার পাথর বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন কর্মকর্তারা।
সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতাঁর মধ্যে দেশে সরকারি নির্মাণ প্রকল্পগুলো গতি হারালেও, মধ্যপাড়ার পাথর বিক্রিতে মন্দা চলছে গত দুই বছর ধরেই।
পাথর বিক্রি না হলে উত্তোলন বন্ধন রাখতে হবে বলে জানিয়েছেন খনি কর্মকর্তারা। এতে কর্মহীন হবে প্রায় ৮০০ শ্রমিক।
মধ্যপাড়ার পাথরের দাম বেশি কেন
খনি কর্মকর্তা ও পাথর ব্যবসায়ীদের মতে, মধ্যপাড়া খনির পাথর বিপণনের জটিল বিধিমালা বেসরকারি ক্রেতাদের নিরুৎসাহিত করছে, কারণ তাদেরকে পাথরের জন্য আগাম বুকিং দিয়ে ব্যাংকে টাকা পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া, খনি থেকে পাথর পরিবহনে নিজস্ব খরচে পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হয়।
২০০৬ সালের বিপণনের গাইডলাইনে— অন্যান্য ক্রেতাদের চেয়ে নির্ধারিত ডিলার ও সরকারি সংস্থাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র পাথর পরিবহনের জন্য নির্মিত ১৩ কিলোমিটার রেলপথও অব্যবহৃত থাকছে, কারণ ট্রাক মালিকদের একটি চক্র রেলপথে পাথর না নিয়ে সড়কপথে নিচ্ছে। এতে দেশের যেকোনো স্থানে মধ্যপাড়ার পাথর পরিবহনের ব্যয়ও অনেক বেড়ে গেছে।
পাথর ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত থেকে আমদানি করা ৫-২০ মিলিমিটার সাইজের পাথরের দাম পড়ছে প্রতি ঘনফুটে (সিএফটি) ১২০-১৩০ টাকা। সেখানে মধ্যপাড়া খনির একই সাইজের প্রতি সিএফটি পাথরের দাম পড়ছে ১৪০ টাকা।
মধ্যপাড়ার শিলা খনি থেকে উত্তোলন করা পাথর মূলত সরকারের রেল, সড়ক, বন্দর, বিদ্যুৎ ও গণপূর্ত কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রধান অবকাঠামোগত কাজে ব্যবহার করা হতো। তখন এসব সংস্থাই নিজ উদ্যোগে পাথর ও অন্যান্য উপকরণ কিনতো। কিন্তু, সরকারি সংস্থাগুলো এসব সরবরাহে বেসরকারি ঠিকাদারদের নিয়োগ দিতে শুরু করলে এই পরিস্থিতি বদলে যায়। কারণ বেসরকারি ঠিকাদারদের বাজার ও আমদানির উৎস থেকে পাথর সংগ্রহের সুযোগ বা স্বাধীনতা ছিল।
একারণে ধীরে ধীরে সরকারি খাতের ক্যাপটিভ মার্কেট হারাতে থাকে মধ্যপাড়া খনি; তবে বাংলাদেশ রেলওয়ে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদী শাসনকাজের মতো এখনও কিছু বাজার রয়েছে। তবে সরকার পতনের পর থেকে এসব অবকাঠামো প্রকল্পের গতি না থাকায়– দেশীয় উৎসের এই পাথর বিক্রিতেও ব্যাপক ভাটা পড়ে।
ডিলার ছাড়া পাথর কেনা যায় না
মধ্যপাড়া খনির পাথর সরাসরি ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হয় না। নির্ধারিত ডিলারদের মাধ্যমে পাথর বিক্রি করা হয়। বর্তমানে ১৫০ জন ডিলার রয়েছেন। যদিও তাদের বিক্রির পরিমাণ নিরাশজনক।
পাথর ব্যবসায়ী ও সাবা ট্রেডার্সের মালিক আবু সিদ্দিক বলেন, 'ভারত থেকে আমদানি করা পাথরের দাম এখন কম, যেকারণে তাঁর সাথে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠে না মধ্যপাড়ায় উত্তোলিত পাথর।'
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মো. সাইফুল ইসলাম গত ২৮ অক্টোবর টিবিএসকে জানান, মধ্যপাড়া খনির মূল ক্রেতা হলো বাংলাদেশ রেলওয়ে ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। 'বর্তমানে রেলওয়ে কোনো পাথর কিনছে না, আবার পরিবহনে সমস্যার কারণে বেসরকারি খাতের ক্রেতারাও আগ্রহী নয়।'
তিনি জানান, এই সমস্যা সমাধানে খনি অঞ্চল থেকে পাথর পরিবহনে ৬৫ কিলোমিটার রেলপথ সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথেই দেখছেন। এছাড়া, মধ্যপাড়ার পাথর ব্যবহার করার অনুরোধ জানিয়ে রেল মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
সচিব সাইফুল ইসলাম আরও জানান যে, বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ড এই খনির পাথর ব্যবহার করছে।
পেট্রোবাংলার অধীন মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড এই খনি থেকে উত্তোলন করা পাথর বিক্রির দায়িত্বে রয়েছে।
কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুর রহমান বলেন, 'আমাদের খনির পাথর বেশিরভাগ ব্যবহৃত হয় রেলওয়ে ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজে। কিন্তু সম্প্রতি দেখা গেছে দেশীয় পাথর সেখানে কাজে লাগছে না। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক যোগাযোগ করা হচ্ছে। এই খনির পাথর ব্যবহার করলে দেশের একমাত্র পাথর খনিতে প্রাণ ফিরবে। সরকারও পাবে লাখ লাখ টাকা রাজস্ব।'
১৯৭৩-৭৪ সনে খনির আবিষ্কার
জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ ১৯৭৩-৭৪ সালে ১ দশমিক ২ রর্গকিলোমিটারের মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনিটি আবিষ্কার করে। উন্নয়ন কাজ শেষে ২০০৭ সালে এখানে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। কিন্তু, উৎপাদন শুরুর পর থেকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে এ খনিটি।
শুরুতে পেট্রোবাংলা প্রতিদিন তিন শিফটে ৫ হাজার টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মাত্র এক শিফটে ৭০০ থেকে ৮০০ টন পাথর উত্তোলন করে। এতে এই প্রতিষ্ঠানের ২০১৩ সাল পর্যন্ত লোকসান হয় শত কোটি টাকা।
২০১৪ সালে ছয় বছরের জন্য খনির উৎপাদন, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় জার্মানিয়া ট্রাস্ট কনসোর্টিয়ামকে (জিটিসি)। তারা সফলভাবে পাথর উত্তোলন বাড়াতে সক্ষম হয়। ফলে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছর থেকে লাভের মুখ দেখেছিল খনিটি।
জিটিসির সাথে প্রথম দফা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর। এরপর দ্বিতীয় দফায় ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আরও ৬ বছর মেয়াদী চুক্তি হয়। বর্তমানে চুক্তি অনুযায়ী, খনি থেকে তিন শিফটে প্রতিদিন সাড়ে ৫ হাজার টন পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে।
পাথর পরিবহনের দখল নিয়েছে ট্রাক মালিকরা
কর্মকর্তারা জানান, দেশের নানান প্রান্তে এই খনি থেকে পাথর পরিবহনে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভৌগোলিক কারণে দেশের উত্তরের এক প্রান্তের এই খনি থেকে পাথর পরিবহনের খরচও বেশি হচ্ছে। এ কারণে খনি কর্তৃপক্ষ বরাবরই এই প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ সমৃদ্ধ করতে রেলপথ চালুর দাবি করে আসছে। কিন্তু, তা ট্রাক পরিবহন ব্যবসায়ীদের কারণে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
খনি-সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, খনির সঙ্গে দিনাজপুরের পাবর্তীপুর উপজেলার ভবানীপুর স্টেশনকে সংযোগ করতে ১৩ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ পাথর সরবরাহকারী রেলপথ রয়েছে। এ রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছিল খনি থেকে পাথর উত্তোলনের গোড়ার দিকে। কিন্তু ট্রাক মালিকরা অদৃশ্য কারণে রেলপথে পাথর না নিয়ে সড়কপথে নেওয়া শুরু করে।
ফলে রেলপথটি ছয় মাসের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। সমস্যা আরও বাড়ে যখন– ২০২৩ সালের প্রথমদিকে ওই রেলপথের ৮.৮ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক চুরি হয়ে যায়।
বর্তমানে সড়কপথে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় মধ্যপাড়া থেকে পাথর সরবরাহ করতে প্রতি টনে খরচ পড়ে ১,২০০ থেকে ১,৩০০ টাকা। চট্টগ্রাম এলাকায় নিতে পড়ে ২,১০০ থেকে ২,২০০ টাকা।
মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানির ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. ওবায়দুল্লাহ জানান, এই রেলপথ বন্ধ থাকার কারণে খনির পাথর ব্যবসায় বড় সংকট তৈরি হয়েছে। এটি সংস্কার করে রেলওয়ে ওয়াগন বা রেলপথে পরিবহন শুরু করলে– ঢাকায় প্রতি টন পাথর পরিবহনের খরচ নামবে মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। চট্টগ্রাম এলাকায় নিতে খরচ পড়বে ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা মাত্র। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেকের বেশি খরচ কমবে।
পাথরের চাহিদা বাড়লেও, বিক্রি কমেছে মধ্যপাড়া খনির
খনি কোম্পানির ২০০৭ সালের এক প্রাক্কলন অনুযায়ী, ওই সময়ে দেশে পাথরের বার্ষিক চাহিদা ছিল ৪৫ থেকে ৬৫ লাখ টন। এরমধ্যে ১৫ লাখ টন আসতো বৃহত্তর সিলেট ও দিনাজপুর অঞ্চল থেকে। চাহিদার বাকি অংশ ভারত ও ভূটান থেকে আমদানি করা হতো।
মধ্যপাড়া মাইনিং কোম্পানি বার্ষিক সাড়ে ১৬ লাখ টন পাথর সরবরাহের আশা করেছিল।
খনি কর্মকর্তাদের মতে , বর্তমানে দেশে পাথরের বার্ষিক চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ১৬ লাখ টনে। এরমধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পায় ১০ লাখ ৬৩ হাজার টন পাথর উত্তোলন করা হয় মধ্যপাড়া খনি থেকে, কিন্তু বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫ লাখ ৭২ হাজার টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উত্তোলন করা হয় ১৩ লাখ ১৬ হাজার টন, যার মধ্যে বিক্রি হয়েছে ৯ লাখ ৭ হাজার টন।
খনি কর্তৃপক্ষ বলছে, এখানে একাধিক সাইজের পাথর উৎপাদন হচ্ছে। এগুলো হলো ০-৫ মিলিমিটার (স্টোন ডাস্ট, যার দাম প্রতি টনে ১,১৫০ টাকা; ৫ থেকে ২০ মিলিমিটার পাথর প্রতি টন ৩ হাজার ২৫০ টাকা; ২০ থেকে ৪০ মিলিমিটার ৩ হাজার ৬০০ টাকা; ৪০ থেকে ৬০ মিলিমিটার ৩ হাজার ৬৫০ টাকা; ৬০-৮০ মিলিমিটার পাথরের দাম ২ হাজার ৬০০ টাকা; বোল্ডার ৩ হাজার ২০০ এবং ফাইন ডাস্ট ৭৪০ টাকা দরে প্রতি টন বিক্রি হচ্ছে।