বুলেটে ঝাঁঝরা খাদ্যনালী, ৪ আগস্টের পর নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে মঞ্জিল মোল্লার
৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গিয়ে পিঠ, হাত ও পেটে গুলিবিদ্ধ হন মুন্সিগঞ্জের মঞ্জিল মোল্লা (৫৩)। গুরুতর আঘাত লাগে খাদ্যনালী বা পরিপাকতন্ত্রে। তখন থেকেই তার দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে।
জানা গেছে, গত ৪ আগস্ট মুন্সিগঞ্জ শহরের সুপারমার্কেটে এক দফা দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। খবর পেয়ে প্রতিহতের ঘোষণা দেয় মুন্সিগঞ্জ ৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফয়সাল বিপ্লব ও তার অনুসারী আওয়ামী লীগ- ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পুলিশও কঠোর অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে।
শান্তিপূর্ণ এই কর্মসূচিতে সেদিন চড়াও হয় সরকারি দলের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও পুলিশ বাহিনী। হামলার মধ্যে মঞ্জিলের ডান হাতে, পিঠে ও পেটে গুলি লাগে। এরমধ্যে একটি বুলেট তার খাদ্যনালী ভেদ করে সেখানে আটকে যায়, যেটি বের করা নিয়ে বেগ পেতে হয় চিকিৎসকদের। পরবর্তীতে খাদ্যনালীর ৪টি নাড়ি কেটে বুলেটটি বের করা হয়। কিন্তু, এজন্য স্বাভাবিক রাস্তা দিয়ে মল বন্ধ রেখে পেটের সাইড দিয়ে কেটে ব্যাগ বসিয়ে দিতে হয় চিকিৎসকদের।
এভাবেই ৪ আগস্টের ভয়াবহ আঘাত পুরো তছনছ করে দিয়েছে মঞ্জিল মোল্লার জীবন। একদিকে প্রাণঘাতী এই আঘাত থেকে সেরে ওঠা, একইসঙ্গে ১০ জনের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় সংসার চালানোর সংগ্রামের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার দুর্বিষহ ভারও বইতে হচ্ছে তাঁকে।
মঞ্জিল মোল্লা দেড় মাস চিকিৎসার পর বাড়ি ফিরেছেন। পরবর্তী অপারেশন হলে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার কথা।
তবে অর্থ সংকটে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন স্বজনরা। অন্যদিকে, একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি অসুস্থ থাকায় উভয় সংকটে রয়েছে পরিবারটি।
এই অবস্থায়, তাঁর চিকিৎসায় সহায়তা দিতে সরকারের কাছে সাহায্যের অনুরোধ জানিয়েছেন তার বন্ধু, আত্মীয়স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা। মঞ্জিলের চিকিৎসার ব্যয়ের পাশাপাশি পরিবারকেও অর্থ সাহায্য দেওয়ার কথা বলছেন তাঁরা, কারণ মঞ্জিলের সাথে তাঁর পরিবারও চরম সংকটে।
মর্মান্তিক সেই দিনের ঘটনা
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সেদিন মুন্সিগঞ্জ সুপারমার্কেট এলাকায় সকাল সাড়ে ৯টায় এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমাবেশ করে, যেখানে হামলা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থক ও নেতাকর্মীরা। সমাবেশ প্রতিহত করার ডাক দিয়েছিলেন, মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফয়সাল বিপ্লব।
অভিযোগ রয়েছে, এসময় আন্দোলনকারীদের লাঠিপেটা করা হয় ও তাঁদের লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে শহরের কৃষি ব্যাংক এলাকা ও উত্তর ইসলামপুর থেকে শত শত আন্দোলনকারী বেড়িয়ে পড়েন। তারা আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে শহরের মূল কেন্দ্র অঙ্কুরিত যুদ্ধ ১৯৭১ ভাস্কর্যের সামনে পর্যন্ত এলে— চরকেওয়ার, আধারা, মোল্লাকান্দি, শিলই থেকে আসা শত শত আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পিস্তল-রাইফেল, শর্টগান, হাতে বানানো অস্ত্র নিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে।
সেসময় আহত মঞ্জিলের ডান হাতে গুলি লাগে। দ্বিতীয় গুলি লাগে পিঠে। এরপর তৃতীয় দফায় পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে অবস্থা গুরুতর হলে মাটিতে লুটে পড়ে যান তিনি।
আন্দোলনকারীদের মধ্যে কয়েকজন মঞ্জিলকে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয় যান, সেখান থেকে আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর দুইবার অস্ত্রোপচার হলেও– খাদ্যনালী স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি বা পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি।
আর্থিক অনটন
মঞ্জিলের বৃদ্ধ মা-বাবাসহ ১০ জনের পরিবার এখন চরম আর্থিক টানাটানির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
মঞ্জিল মোল্লার বড় মেয়ে রুপা আক্তার বলেন, 'আমার বাবার পরবর্তী অপারেশনের জন্য ২-৩ লাখ টাকা প্রয়োজন। এই ব্যয় মিটানো আমাদের পক্ষে সম্ভব না। সরকারিভাবে বহন করা হবে কি না তারও কোন নিশ্চয়তা পাচ্ছি না। আমার এক ভাই বিবাহিত, সেও বেকার। আমাদের দাদা-দাদীসহ ১০ সদস্যের পরিবার। বাবাই একমাত্র উপার্জন করেন। তার আয়ে সংসার চলে। এভাবে কতদিন চলতে পারব জানি না। সরকারের প্রতি আহবান আমাদের পরিবারটির দিকে তারা যেন নজর দেয়।'
চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ নিয়েও চরম দুর্ভাবনায় দিন কাটছে পরিবারটির।
পরিবারটির একজন প্রতিবেশী রবিউল মাষ্টার বলেন, 'উনার একটা ছেলে আছে, অনেক কষ্ট করে বাড়ির পেছনের জমি বিক্রি করে তাকে এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছেন। কিন্তু ওই ছেলের কাজ নেই, বেকার। সরকারের কাছে আমাদের আশা- তারা যদি ছেলেটাকে একটা কাজ দেয়– তাহলে সংসারটা বেঁচে যাবে। নাহলে কয়দিন পরে তাদের পথে বসতে হবে।'
স্থানীয়রাও পরিবারটির বর্তমানে আর্থিক সাহায্য প্রয়োজন বলে জানান এবং এবিষয়ে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
স্থানীয় ফয়সাল হোসেন বলেন, 'উনার দুইটা সহযোগিতা দরকার। এমন একটা ব্যবস্থা হোক যাতে উনার পরিবারটা চলতে পারে, আরেকটা বিষয় হচ্ছে সরকার এমন দায়িত্ব নিক যেন যে পর্যন্ত উনি পুরোপুরি সুস্থ নাহয়– সে পর্যন্ত সকল ব্যয়ভার বহন করে।'
মুন্সিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মো. মঞ্জুরুল আলম বলেন, 'আহত মঞ্জিলের বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিয়েছি। সরকারের পক্ষ থেকে আহতদের তালিকা করতে আমাদের ওপর নির্দেশনা রয়েছে। সেখানে মঞ্জিলকেও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। আশা করছি, তিনি সরকারের প্রতিশ্রুত সহায়তা পাবেন। এছাড়া তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা সিএমএইচে যোগাযোগ করলে— পরবর্তী চিকিৎসাটি বিনামূল্যে সম্পন্ন করতে পারবেন বলে আশা করছি।'
এদিকে, আন্দোলনে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে আহতের ঘটনায় মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় লিখিত অভিযোগের প্রস্তুতি নিয়েছে মঞ্জিলের পরিবার।
মুন্সিগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খলিলুর রহমান বলেন, '৪ আগস্টের ঘটনায় এখন পর্যন্ত সদর থানায় ৩টি হত্যামামলা, একটি ভাঙচুরের মামলা ও আহতের ঘটনায় আরও একটি মামলা দায়ের হয়েছে। আহত মঞ্জিলের ঘটনায় অভিযোগ পেলে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।'