ভোগ্যপণ্যের আমদানি কমায় রমজানে চাহিদা সামলাতে উদ্যোগ সরকারের
অর্থবছরের প্রথম চার মাসে কিছু পণ্যের আমদানি কমে যাওয়ায় রমজান মাসে চাহিদা বৃদ্ধি সামাল দিতে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, সরকার চাল, চিনি এবং গমসহ গুরুত্বপূর্ণ পণ্যগুলোর প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ দিয়ে আমদানির অনুমোদন দিয়েছে।
বুধবার (৬ নভেম্বর) সচিবালয়ে খাদ্য পরিকল্পনা ও সংগ্রহ কমিটির বৈঠক শেষে তিনি বলেন, 'আমরা আশা করছি, এই অত্যাবশ্যকীয় পণ্যগুলো খুব শিগগিরই [দেশে] পৌঁছাবে।'
তিনি আশ্বস্ত করেন, রমজানে চাল, গম, ডাল এবং খেজুরসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কোনো ঘাটতি হবে না। তিনি বলেন, 'খাদ্য সরবরাহের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।' এ সময় তিনি মজুত পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং আমদানির প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণে গুরুত্বারোপ করেন। এছাড়া বেসরকারি খাতের আমদানিকে উৎসাহিত করার কথাও উল্লেখ করেন, যাতে এসব পণ্যের সরবরাহ দ্রুত নিশ্চিত করা যায়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে পরিশোধিত পাম তেলের আমদানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ৬৯৩ মেট্রিক টন থেকে কমে চার লাখ ৩৪ হাজার ১৬৮ মেট্রিক টনে নেমে এসেছে। ছোলা ও চিনির আমদানিও যথাক্রমে ১১ হাজার ৩৬৬ মেট্রিক টন থেকে দুই হাজার ৬৮২ মেট্রিক টনে এবং এক লাখ এক হাজার ১৪৩ মেট্রিক টন থেকে ৮১ হাজার ৬৮৮ মেট্রিক টনে নেমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যও আমদানির এ নিম্নমুখী প্রবণতা নিশ্চিত করেছে। গত বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ঋণপত্র খোলা প্রায় ৭% এবং এলসি নিষ্পত্তি ২.৫% কমেছে।
তবে কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানি বেড়েছে। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, সয়াবিন তেলের আমদানি এক লাখ ৬৪ হাজার ৯৮৯ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে দুই লাখ ২৮ হাজার ১৬৫ মেট্রিক টনে এবং মসুর ডালের আমদানি ৬৫ হাজার ৯৯৬ মেট্রিক টন থেকে এক লাখ ৮৯ হাজার ৫৬০ মেট্রিক টনে পৌঁছেছে।
ব্যবসায়ীরা যা বলছেন
বেসরকারি আমদানিকারকেরা রমজানের চাহিদার কথা মাথায় রেখে ঋণপত্র (এলসি) খুলে প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
রমজানের আগের মাসগুলোতে সাধারণত আমদানির তৎপরতা তুঙ্গে থাকে। তবে এলসি চালু হওয়ার পর পণ্যগুলো দেশে পৌঁছাতে প্রায় দুই মাস লেগে যায়।
এ বছর আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের উচ্চমূল্য, ব্যাংকগুলোর সীমিত ক্রেডিট লাইন এবং অর্থনৈতিক চাপের কারণে ব্যবসায়ীরা সরবরাহে স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
দেশের অন্যতম প্রধান আমদানিকারক সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, 'আমরা ইতোমধ্যে রমজানের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর আমদানি শুরু করেছি। তবে ৮-১০টি ব্যাংকের ক্রেডিট লাইন খারাপ হওয়ায় সেসব ব্যাংক থেকে ঋণপত্র খুলতে পারছি না। এ পরিস্থিতিতে বিকল্প ব্যাংকিং সুবিধা, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের সহায়তা সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বিবেচনা করা উচিত।
'এছাড়া একক গ্রাহক ঋণসীমা ১৫% থেকে বাড়িয়ে ২৫% করা উচিত।' বিশ্বজিৎ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ভোজ্যতেলের দামে ২৫% বৃদ্ধির কথা জানিয়ে বলেন, ভর্তুকি বা মূল্য সমন্বয়ের মাধ্যমে সরকারি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হতে পারে।
চট্টগ্রামের ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকদের কাছ থেকে এ বছর মুদিপণ্য আমদানির এলসি আগের বছরের তুলনায় কম।
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সাব্বির আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'সরকার পরিবর্তনের পর থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য খোলা এলসির সংখ্যা অর্ধেক হয়ে গেছে। গত কয়েক বছর আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা দেশের বড় কিছু শিল্পগ্রুপ সীমিত ব্যাংকিং সুবিধা পাচ্ছে।'
সাব্বির আরও বলেন, আগে যেসব মাঝারি বা ছোট মানের আমদানিকারক ছিল, গত কয়েক বছর ব্যাংকিং সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় অনেকে ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়েছেন।
বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যার প্রেক্ষাপটে শিল্পসংশ্লিষ্টরা রমজানে সরবরাহ স্থিতিশীল করতে এ ছোট আমদানিকারকদের জন্য নতুন ব্যাংকিং সহায়তার সুপারিশ করেছেন।
খাতুনগঞ্জের একটি বিশিষ্ট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স জামান অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী নুরুল আলম বলেন, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অবস্থা ভোক্তাদের আচরণে প্রভাব ফেলেছে।
'মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা কমে গেছে, অর্থব্যয়ে তারা আগের চেয়ে হিসেবি হয়েছে। রমজানে চাহিদার চেয়ে বাড়তি পণ্য আমদানি হলে ব্যবসায়ীদের লোকসানে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে আমদানিকারকরা সতর্কভাবে এগোচ্ছেন,' বলেন তিনি।
চার দশক ধরে মুদিপণ্য আমদানি করা আলম প্রকৃত আমদানিকারকদের জন্য ব্যাংকের সীমিত সহায়তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, 'চলমান তারল্য সমস্যার জন্য এ সীমিত সহায়তা দায়ী। মহামারির পর থেকে, বিশেষ করে ডলার সংকটের পর থেকে, ব্যাংকগুলো ছোট ও মাঝারি আকারের আমদানিকারকদের নিরুৎসাহিত করছে। এদিকে ফটকা আমদানিকারকেরা আমদানি সুবিধার অপব্যবহার করে আমদানির নামে ব্যাংক থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।'
ক্রমবর্ধমান ভোজ্যতেলের দাম উদ্বেগ বাড়াচ্ছে
আন্তর্জাতিক ভোজ্যতেলের বাজারে মূল্যবৃদ্ধি রমজানের জন্য আমদানিকারকদের পরিকল্পনায় প্রভাব ফেলেছে।
মেঘনা গ্রুপের উপ-মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার বলেন, ইতোমধ্যে বুক করা পণ্যগুলো রমজানের চাহিদা মেটাতে পারলেও ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
শাহরিয়ার বলেন, 'গত দুই মাসে ভোজ্যতেলের দাম প্রতি মেট্রিক টনে ২০০ ডলার পর্যন্ত বেড়েছে। বর্তমান দামের ভিত্তিতে আমদানিকারকরা দেশীয় বাজারে দাম সমন্বয় করা ছাড়া কোনো বিকল্প দেখছেন না।'
তিনি আরও উল্লেখ করেন, সয়াবিন তেল দুই মাস আগে প্রতি মেট্রিক টন ৯৮০ ডলারে বিক্রি হলেও এখন এক হাজার ২৪০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। অপরিশোধিত পাম তেলের দাম প্রতি টন ৯৭০ ডলার থেকে বেড়ে ১,১৮০-১,১৯০ ডলারে পৌঁছেছে।
উচ্চমূল্য শিল্পে চাপ তৈরি করছে বলে কিছু আমদানিকারক মনে করছেন, ভোক্তাদের ব্যয়ের চাপ কমাতে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হতে পারে।