সার আমদানিতে প্রথামবারের মতো ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ
সার আমদানির জন্য প্রথমবারের মতো বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ পেতে যাচ্ছে সরকার। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্য, ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) থেকে সার আমদানিতে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা জানান, দেশের কৃষি খাতকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় সারের সরবরাহ নিশ্চিত করতেই সংস্থাটির কাছে এই তহবিল চাওয়া হয়েছে।
আসন্ন ডিসেম্বরে বোরোর পিক (সর্বোচ্চ) মৌসুমে ইউরিয়া সারের ঘাটতি হতে পরে— এমন শঙ্কায় গেল সেপ্টেম্বরে উদ্বেগ জানায় কৃষি মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই তহবিল চেয়ে অনুরোধ করে অন্তর্বর্তী সরকার।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)-এর অক্টোবরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে ইউরিয়ার চাহিদা রয়েছে ১৮ লাখ টন। তবে বর্তমানে প্রায় ৫ লাখ টনের মজুদ রয়েছে। দেশে ইউরিয়ার চাহিদা মূলত মেটানো হয় আমদানির মাধ্যমেই।
কয়েক দশক ধরে, আইটিএফসি বাংলাদেশকে প্রধানত জ্বালানি (পেট্রোলিয়াম, এলএনজি) আমদানির জন্য ঋণ দিয়ে আসছে; তবে সার আমদানির জন্য এই প্রথম বৈদেশিক ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ।
পাশাপাশি এই আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থার কাছে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানিতেও সরকার ১ বিলিয়ন ডলার চেয়েছে বলে জানায় ইআরডি সূত্র।
কর্মকর্তারা জানান, আইটিএফসি বাংলাদেশকে সার আমদানির জন্য ঋণ দিতে সম্মতি দিয়েছে। তবে চলতি বছরেই এই ঋণ ছাড় হবে কিনা সেটি এখনও নিশ্চিত করেনি।
ইআরডির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না শর্তে জানান, "সার আমদানি ঋণ চলতি অর্থবছরে পেলে ভালো হবে। সেই অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে জন্য এই ঋণের অনুরোধ জানানো হয়েছে।"
গত মাসে চিফ অপারেটিং অফিসার নাজিম নুরদালির নেতৃত্বে আইটিএফসি প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফরের সময় হওয়া বৈঠকে এই ঋণের অনুরোধ জানানো হয়েছিল।
আলোচনায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পেট্রোবাংলা, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, কৃষি মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিরা।
কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান— অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং ইআরডির সাথে সমন্বয় করে কৃষি মন্ত্রণালয় আইটিএফসি'র রিভিউয়ের জন্য একটি খসড়া ঋণ প্রস্তাব তৈরি করবে। তার ওপর ভিত্তি করে নতুন খাতে ফান্ডিং বা তহবিল বিতরণের সম্ভব্যতা যাচাই করবে আইটিএফসি। বৈঠকে এমনটিই আলোচনা হয়েছে বলে জানান তারা।
ওয়াশিংটনে গত ২১-২৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ'র বার্ষিক সম্মেলন চলাকালে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে এক পার্শ্ব বৈঠকে (সাইড মিটিং) জ্বালানি ও সার আমদানির জন্য বাংলাদেশকে ২ বিলিয়ন ডলার তহবিল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন আইটিএফসি প্রতিনিধিরা।
বিসিআইসি'র তথ্য অনুসারে— বাংলাদেশে ইউরিয়া, টিএসপি এবং ডিএপি-সহ বার্ষিক ৬৮ লাখ টন বিভিন্ন সারের প্রয়োজন হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে ইউরিয়ার বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৭-৩০ লাখ টন— যা প্রাথমিকভাবে আমদানির মাধ্যমে পূরণ হয়ে থাকে। যদিও স্থানীয়ভাবে ইউরিয়া উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১০ লাখ টন, তবে গ্যাস সংকটের কারণে সার কারখানাগুলো নিষ্ক্রিয় পড়ে থাকায় তা পূরণ করা সম্ভব হয় না।
আগামী দুই বছরে আইএসডিবি থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণের আশা
আইটিএফসি হলো, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইএসডিবি) গ্রুপের একটি স্বায়ত্তশাসিত সত্তা। প্রাথমিকভাবে, এটি অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) সদস্য দেশগুলোতে (যেমন– বাংলাদেশ) বাণিজ্য অর্থায়ন প্রদান বা ঋণ বিতরণ করে থাকে।
চলতি ২০২৪ সাল থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে, আইএসডিবি বাংলাদেশে মোট ৫.১৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এরমধ্যে ৩.৬ বিলিয়ন ডলার দেওয়া হবে আইটিএফসির মাধ্যমে।
পেট্রোলিয়াম জ্বালানি এবং এলএনজি আমদানিতে ২০২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের জন্য ২.১ বিলিয়ন ঋণ অনুমোদন দিয়েছে আইটিএফসি। এরমধ্যে ১.৬ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) জন্য এবং ৫০০ মিলিয়ন ডলার পাবে পেট্রোবাংলা। ঋণটিতে ছয় মাসের এসওএফআর প্লাস ১.৮০ শতাংশ সুদহার এবং ০.২ শতাংশ প্রশাসনিক ফি রয়েছে।
এর আগে, ২০১২ সালে দেশের জ্বালানির চাহিদা পূরণে অপরিশোধিত তেল আমদানির জন্য আইটিএফসির কাছ থেকে ২.৬ বিলিয়ন ডলার নিয়েছিল বাংলাদেশ। এরপর এই সংস্থা থেকে এটিই সবচেয়ে বড় ঋণ।
১৯৭৭ সাল থেকে আইএসডিবি বাংলাদেশকে ঋণ প্রদান করছে। ১৯৯৭ সাল থেকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) জ্বালানি তেল আমদানির জন্য এই সংস্থার কাছ থেকে তহবিল গ্রহণ করছে।
এদিকে, ২০০৮ সাল থেকে আইএসডিবি তার সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) এর মাধ্যমে ঋণ প্রদান অব্যাহত রেখেছে। ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আইটিএফসি বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় ১৮.২৫ বিলিয়ন ডলার অবদান রেখেছে।
১৯৯৭ থেকে ২০২৩-২৪ সালে আইএসডিবি/আইটিএফসি থেকে ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২২.৫৮ বিলিয়ন ডলারে।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, আইটিএফসি থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য বার্ষিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় সৌদি আরবের জেদ্দায়। সেখানে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ ব্যাংক-সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আইটিএফসি'র প্রতিনিধিদের আলোচনা হয়েছে। রেয়াতহীন ঋণ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির (স্ট্যান্ডিং কমিটি ফর নন-কনসেশনাল লোন) অনুমোদনের পর, এই তহবিল জ্বালানি তেল আমদানিতে ব্যবহৃত হয়।
আইটিএফসি মহামারি চলাকালীন খাদ্য নিরাপত্তাও বাংলাদেশে ২৫ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করেছিল।