উদ্বোধনের এক বছর পরেও অলস পড়ে আছে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ, সহসা শুরু হচ্ছে না বাণিজ্য
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণে – প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেলপথ – উদ্বোধনের এক বছর পরেও অলস পড়ে আছে।
এই রেলপথ দিয়ে ট্রেন চলাচলের কয়েক দফার ট্রায়াল রান সম্পন্ন হলেও – দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অবকাঠামোগত কাজ অসম্পূর্ণ থাকায় – বাণিজ্য শুরু বিলম্বিত হচ্ছে।
উভয় দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সুবিধার্থে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার গঙ্গাসাগর রেলওয়ে স্টেশন থেকে আগরতলার নিশ্চিন্তপুর পর্যন্ত ১২.২৪ কিলোমিটার রেলপথটি নির্মাণ করা হয়। এরমধ্যে বাংলাদেশ অংশে পড়েছে ৬ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার। ২৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ অংশের নির্মাণ কাজ করেছে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেক্সমেকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড।
দেড় বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে নির্মাণ কাজ শুরু হলেও – করোনা মহামারিসহ নানা সংকটে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে সময় লেগেছে ৬ বছরেরও বেশি।
২০২৩ সালের ১ নভেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যে রেলপথটির যৌথ উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। উদ্বোধনের একদিন আগে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানির অনুমতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। নতুন এই রুট দিয়ে ভারত থেকে অর্ধশতাধিক পণ্য আমদানি এবং সব ধরনের পণ্য রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের।
তবে তখনও ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস ভবন, প্ল্যাটফর্ম এবং সংযোগ সড়কের মতো জরুরি অবকাঠামোর নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। অবশেষে পুরোপুরি শেষ হয়েছে এগুলোর নির্মাণ কাজ এবং চলতি মাসেই প্রকল্পটি সরকারের কাছে বুঝিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
টেক্সমেকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ভাস্কর বকশি জানান, 'কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। ফলে এখন প্রকল্পটি সরকারের কাছে হস্তান্তর প্রক্রিয়া চলছে। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এ সংক্রান্ত চিঠিও দেওয়া হয়েছে।'
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, চলতি মাসেই হস্তান্তর করা হতে পারে, রেলপথটি পরিচালনার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলেই বাণিজ্য শুরুর হতে পারবে। তবে কবে নাগাদ বাণিজ্য শুরু হবে তা এখনও অনিশ্চিত।
বর্তমানে এই রেলপথে ট্রেন চলাচল করছে না। এদিকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণে রেলপথটি নির্মিত হলেও কার্যত এটি ব্যবহৃত হবে ভারতের বাণিজ্যিক স্বার্থে। এটা বাংলাদেশের রপ্তানিও সেভাবে বাড়বে না– যেমনটা শুরুতে বলা হয়েছিল।
শিলিগুড়ি করিডর বাইপাস করে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে উত্তরপূর্বের সাথে যোগ করেছে এই রেলপথ। এতে করে পণ্য পরিবহনে সময় ও খরচ কমবে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের। এতে তারাই ব্যবসায়ীরা বেশি লাভবান হবেন। যার ফলে, আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির পরিমাণও কমবে। কারণ তখন ভারতের ব্যবসায়ীরা নিজ দেশের অন্য অঞ্চলের উৎস থেকেই এসব পণ্য আনতে পারবেন।
এটি চালু হলে বাংলাদেশের রপ্তানির বিষয়ে আশঙ্কার কথা তুলে ধরে আখাউড়া স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক রাজীব ভূঁইয়া বলেন, 'ভারতের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পণ্য রপ্তানি কমেছে। বর্তমানে সীমিত যে কয়েকটি পণ্য নিয়মিত রপ্তানি হয় তার মধ্যে অন্যতম রড ও সিমেন্ট। মূলত ত্রিপুরার ব্যবসায়ীরা এ দুই পণ্যে ভারতের অন্য রাজ্য থেকে আনতে গেলে খরচ পড়ে বেশি। ফলে তারা বাংলাদেশ থেকে আমদানি করেন। তবে আখাউড়া-আগরতল রেলপথ ব্যবহার করে কম খরচে ত্রিপুরার ব্যবসায়ীরা রড ও সিমেন্টের মতো চাহিদা সম্পন্ন পণ্যগুলো পরিবহন করতে পারবেন। এতে করে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে'।
আখাউড়া স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাসিবুল হাসান জানান, রেলপথ দিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য খুব বেশি বাড়বে না। তবে পণ্য আমদানির মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব। তিনি বলেন, 'যদি সব ধরনের পণ্য আমদানির সুযোগ দেয়া হয়- তাহলে যখন যে পণ্যের চাহিদা, সেই পণ্য রেলে কম খরচে আমদানি করে ব্যবসায়ীরা মুনাফা করতে পারবেন। এতে সরকারেরও রাজস্ব বাড়বে।'
রেলপথটি কবে নাগাদ চালু হবে এবিষয়ে মন্তব্যের জন্য ফোন করে পাওয়া যায়নি রেলওয়ের বাংলাদেশ অংশের প্রকল্পের পরিচালক আবু জাফর মিয়াকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গাজালা পারভীন রূহি বলেন, 'কখন রেলপথ দিয়ে ট্রেন চলবে সেটি সরকারি সিদ্ধান্ত। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাণিজ্য শুরুর বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। ঠিাকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটি হস্তান্তর করলে– তখন বাণিজ্য শুরুর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে এবং সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে একটি সিদ্ধান্ত আসবে।'
আপাতত আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ অব্যবহৃতই রয়ে গেছে, এবং কবে এটি চালু হবে এবং এ থেকে আদৌ কোনো বাণিজ্যিক সুবিধা মিলবে কিনা– তা নিয়েও অনিশ্চিত সংশ্লিষ্টরা।