ঢাকার সব বাস নগর পরিবহনের আওতায় আনার উদ্যোগ পুনর্জীবিত, তবে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে
রাজধানীতে চলাচল করা বাসগুলোকে ঢাকা নগর পরিবহনের আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ আবারো ফিরিয়ে আনতে চায় বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি।
গতকাল সোমবার কমিটির ২৯তম সভা শেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক ও কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, 'ঢাকায় যেকোনো রুটে কোনো কোম্পানির বাস চলতে হলে নগর পরিবহনের আওতায় আসতে হবে।'
নগরীতে বিভিন্ন রুটে যেসব কোম্পানির বাস চলাচল করে, সবার ক্ষেত্রে এই ম্যান্ডেট প্রযোজ্য হবে, যার মাধ্যমে একটি একক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করাটাই হলো লক্ষ্য।
নগরীর বিশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং গণপরিবহন ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের প্রতিকূলতাগুলো মোকাবিলায়— এই উদ্যোগকে একটি টেকসই সমাধান হিসেবে দেখছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাস মালিকরা।
২০১৬ সালে নগর পরিবহন চালুর উদ্যোগ প্রথমে নিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটির সাবেক মেয়র আনিসুল হক।
পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকার তিন রুটে নগর পরিবহন তখন চালু করাও হয়, কিন্তু পরের বছরগুলোয় তা ধাপে ধাপে মুখ থুবড়ে পড়ে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরীক্ষামূলক পর্যায়ের বাইরে যেতে না পারাটা ছিল এই ব্যবস্থাটি ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ। সাম্প্রতিক উদ্যোগটিতে অতীতের ত্রুটিগুলো সংশোধন করে ঢাকার সব বাসকে একটি স্ট্যান্ডার্ডাইজড ও রুট-ভিত্তিক মডেলে আনার প্রয়াস থাকবে।
বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির গতকালকের সভায় নজরুল ইসলাম ঢাকার ৪২টি রুটের বাসগুলো নগর পরিবহনের আওতায় পরিচালনার বিষয়ে পরিকল্পনা তুলে ধরেন। এসব বাসের মালিক কোম্পানিগুলো নির্দিষ্ট যোগ্যতার ভিত্তিতে বাস পরিচালনার অনুমোদন পাবে।
তিনি আরও বলেন, "আমরা ছোট (১০-১২ জনের) একটি কমিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই কমিটি বিজনেস মডেল এবং বাসগুলো কীভাবে চলবে সেই বিষয়ে রূপরেখা তৈরি করবে। উদ্যোগটিকে এগিয়ে নিতে আমরা আগামী ১১ ডিসেম্বর আবার মিটিং করবো।"
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)-র নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার বলেন, ঢাকায় গণপরিবহন পরিচালনায় আগ্রহী সবাইকে আমরা নগর পরিবহনে যুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করতে বলেছি। গতকাল পর্যন্ত ৮০টি বাস কোম্পানি আবেদন করেছে। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এ আবেদন করা যাবে।
ডিটিসিএ'র তথ্যমতে, ঢাকায় ১০ হাজার বাসের প্রয়োজন থাকলেও – রয়েছে মাত্র ৭ হাজার। রয়েছে দক্ষ বাসচালকেরও সংকট।
টিবিএসের সাথে আলাপকালে কমিটির একাধিক সদস্য বলেছেন, বাস কোম্পানিগুলো নির্বাচন, বাসের ফিটনেস নিশ্চিতকরণ ও কর্মী নিয়োগসহ সম্পূর্ণ নগর পরিবহন ব্যবস্থা বাস্তবায়নে দুই বছরের মতো লাগবে। তবে বাসগুলোকে এই ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করে আগামী ছয় মাসের মধ্যে রুট-ভিত্তিক একটি মডেল চালু হবে। বাকী কাজগুলো পর্যায়ক্রমে করা হবে।
তিন বছরেও কেন চালু হয়নি নগর পরিবহন
পরীক্ষামূলকভাবে ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাজধানীর ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর রুটে দিয়ে প্রথম ঢাকা নগর পরিবহনের যাত্রা শুরু হয়। ওইসময় মোট ৫০টি সবুজ রঙের বাস দিয়ে চালু হয়েছিল সেবাটি। এরপরে কয়েকধাপে ১০০টিরও বেশি বাস দিয়ে তিনটি রুটে পরীক্ষামূলকভাবে নগর পরিবহন চলতে থাকে। কিন্তু একই রুটে নগর পরিবহনের সাথে অন্য বাসও চলতো। এই প্রতিযোগিতা ও পরিচালনগত সমস্যায় প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে।
শুরুতে অনেক আশা জাগালেও, এসব কারণে উদ্যোগটি হোঁচট খায় এবং প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়। এই মুখ থুবড়ে পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে পাইলটিং থেকে বেরিয়ে না আসাকে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সদস্য ড. এস এম সালেহ উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নগর পরিবহন চালুর পরে পাইলটিং তো বছরের পর বছর চলতে পারে না। এর পাইলটিং এর সময় একই রুটে নগর পরিবহনের সাথে অন্য বাসও চলতো। এজন্যই এই ব্যবস্থা ফলপ্রসূ হয়নি। এখন যেভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী আগানো হচ্ছে— তাতে ঢাকার বাসগুলো শৃঙ্খলায় আসবে।"
তিনি বলেন, "আগের কমিটিকে আমরা বোঝাতেই পারতাম না যে একইসাথে দুই ধরনের বাস চলাচল করলে এই ব্যবস্থা ফাংশনাল হবে না। একইরুটে নগর পরিবহনের বাইরে অন্য কোনো বাস চলাচলের সুযোগ দেওয়া যাবে না। আর নগর পরিবহন ইন্টিগ্রেশন হলে এর সাথে ঢাকার পাশ্ববর্তী জেলাগুলোর এবং দূরপাল্লার বাসগুলো সহজে ইন্টিগ্রেট করতে পারবে।"
এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, "ঢাকায় চলাচলরত বাসগুলোর মধ্যে যেগুলোর নূন্যতম ৫ বছর মেয়াদ আছে সেগুলো রিপেয়ার করে নগর পরিবহনের বহরে যুক্ত হতে পারবে। এছাড়া এই প্রকল্পে নতুন বাস ক্রয়েরও পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের এজন্য চার থেকে সাড়ে চার হাজার নতুন বাস কেনার সুযোগ রয়েছে।"
নগরীর ২৯১ রুটকে মাত্র ৪২টিতে অন্তর্ভুক্ত করে —ছয়টি ক্লাস্টারের প্রতিটি রুটের জন্য পৃথক রঙের বাস চালুর পরিকল্পনা করা হয়েছিল নগর পরিবহনের শুরুতে। তবে ২০১৭ সালে মেয়র আনিসুলের মৃত্যুর পরেই উদ্যোগটি গতি হারাতে থাকে।
বাস মালিকদের নগর পরিবহন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে অনীহা ছিল। ফলে তাঁদের থেকে তেমন সাড়াও মেলেনি। একইসঙ্গে সেবাটির বাজে পারফরম্যান্সের কারণে নগর পরিবহন ব্যবস্থাপনায় হিমশিম খায় নগরীর দুই সিটি করপোরেশন।
সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের পর– ২০১৮ সালে ফের বাস রুট যৌক্তিকীকরণের বিষয়টি সামনে আসে। তবে পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও সরকারি কর্মকর্তাসহ এবিষয়ে গঠিত ১০ সদস্যের কমিটি তেমন কোনো অগ্রগতি করতে পারেনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের নেতৃত্বে ধারণাটি আবারো সামনে আসে, এবং ২০২১ সালে দায়িত্ব নিয়ে তিনি নগর পরিবহনের নতুন কয়েকটি রুটও চালু করেন।
এজন্য বিআরটিসির ৩০টি ওয়াইড বডি বাসও নামানো হয়। আরও ৭০টি বাস বেসরকারি বাস কোম্পানিগুলো দেবে বলে আশা করা হয়েছিল। তবে মাত্র ছয়টি বেসরকারি কোম্পানি অল্পকিছু বাস নিয়ে এ উদ্যোগে যুক্ত হয়।
নগর পরিবহনের পরিকল্পনাকারী ১২ সদস্যের কমিটির একজন সদস্য এম এ বাতেন এই ব্যবস্থাটি বাস্তবায়নের বিষয়ে বলেন, "মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শনের পর ঢাকা শহরের ৩৫০ রুটে চলাচল করছে এমন শত শত কোম্পানির কয়েক হাজার বাসকে কীভাবে ৪২ রুটের অন্তর্ভুক্ত করা যায়– সেবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি।" বাতেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিরও সভাপতি।
তিনি আরও বলেন, পুরো ব্যবস্থাটি রাতারাতি পরিবর্তন করা যাবে না, ঢাকা শহরের পরিবহন ব্যবস্থায় বর্তমান যে বিশৃঙ্খলা সেটা যেন আরও না বাড়ে– সেজন্য সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। "যেসব বাসের ইকোনমিক লাইফ আর নেই, ধীরে ধীরে সেগুলো সড়ক থেকে সরাতে হবে, আর ফিটনেস থাকা সব বাস যেন নগর পরিবহনের অন্তর্ভুক্ত হয় আমরা তা নিশ্চিত করব।"
ঢাকায় দক্ষ বাসচালকদের সংকট থাকার কথা স্বীকার করেন বাতেন। যা কাটিয়ে উঠতে বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালুর আহ্বান জানান তিনি। একইসঙ্গে বাস মালিকরা যাতে পুনর্গঠিত এই পরিবহন ব্যবস্থার জন্য নতুন বাস কিনতে পারেন- সেজন্য তাঁদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের পরামর্শও দেন।