আশুলিয়ার হত্যা মামলা: নিহত যুবককে চেনেন না বাদী, প্রলোভন দেখিয়ে মামলা দায়েরের অভিযোগ
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ঢাকার আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ছোড়া গুলিতে আল আমীন নামে এক ব্যক্তি নিহত হন বলে দাবি করেন তার স্ত্রী কুলসুম বেগম। এই ঘটনায় কুলসুম বেগম থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন।
তবে, প্রায় তিন মাস পর গত সোমবার (১১ নভেম্বর) সিলেট মহানগরীর দক্ষিণ সুরমা থানায় এসে নিজেকে জীবিত দাবি করে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন স্ত্রীর মামলায় 'নিহত' উল্লেখ করা সেই আল আমীন।
এদিকে, সংঘর্ষে নিহত অজ্ঞাতনামা এক যুবককে নিজের স্বামী আল আমীন দাবি করে আদালতে দায়ের করা মামলাটির বাদি কুলসুম বেগম বলেছেন, সংঘর্ষে নিহত সেই যুবককে চিনতেন না তিনি।
আজ শুক্রবার (২২ নভেম্বর) সকালে আশুলিয়া থানায় অবস্থানকালে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে এসব কথা বলেন তিনি।
তিনি দাবি করেন, শফিক এবং রুহুল আমীন নামের দুই ব্যক্তি মূলত চাকুরির কথা বলে তার কাছ থেকে কাগজপত্র সংগ্রহ করে এবং সরকার থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাকে দিয়ে মামলাটি দায়ের করায়।
তবে কুলসুম বেগমের স্বামী আল আমীন ১১ নভেম্বর সিলেটের সুরমা থানায় হাজির হয়ে বলেন, তার অজান্তে তার স্ত্রী কুলসুম বেগম 'অসৎ' উদ্দেশ্যে তাকে মৃত দেখিয়ে আদালতে মামলাটি দায়ের করেছেন। ফলে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
পরবর্তীতে ১৩ নভেম্বর আশুলিয়া থানার মাধ্যমে কুলসুম বেগমের স্বামী আল আমীন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির হয়ে জবানবন্দি দেন।
এদিকে আল আমীন প্রকাশ্যে আশার পর থেকে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে চলে যান মামলার বাদি কুলসুম বেগম। ফলে পুরো বিষয়টি রহস্যাবৃত হয়ে পড়ে।
সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) রাতে কক্সবাজার থেকে মামলার বাদি কুলসুম বেগমকে উদ্ধার করে আশুলিয়া থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। একইসাথে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রুহুল আমীন ও শফিউদ্দিন নামে দুই ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে।
আটক রুহুল আমীন জামগড়া দক্ষিণপাড়া এলাকার মৃত মাসুম আলীর ছেলে। তার জন্মস্থান মানিকগঞ্জ। অন্যদিকে আটক শফিউদ্দিন মানিকগঞ্জের শিবালয় থানাধীন উথলী এলাকার মনসুর আলীর ছেলে।
আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক টিবিএসকে বলেন, "মামলাটি আদালতে দায়েরের পর যাকে মৃত দাবি করে আদালতে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে, কুলসুমের সেই স্বামী থানা ও আদালতে হাজির হলে পুলিশ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে। কিন্তু আত্মগোপনে থাকায় কুলসুমের সাথে কোনোভাবে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। সর্বশেষ গতকাল কক্সবাজার থেকে কুলসুমকে উদ্ধার করার পাশাপাশি দুই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে।"
আজ তাদের সবাইকে আদালতে পাঠানো হবে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
এছাড়াও, যেই অজ্ঞাতনামা যুবকের মৃত্যু সনদ ও হাসপাতাল প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে, সেই যুবকের পরিচয় শনাক্তেও পুলিশ কাজ করছে বলে জানান তিনি।
পুলিশ কর্তৃক উদ্ধার হওয়ার পর আশুলিয়া থানায় অবস্থানকালীন কুলসুম বেগম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, গত ২৮ আগস্ট পারিবারিক কলহের জেরে সিলেটের স্বামীর বাসা থেকে বের হয়ে সন্তানকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জে চলে যান তিনি।
পরবর্তীতে একদিন সাভার থেকে মানিকগঞ্জ যাওয়ার পথে শফিক (মো. শফিউদ্দিন) নামে এক ব্যক্তির সাথে তার পরিচয় হয়। এর কিছুদিন পর শফিক কুলসুমকে চাকুরি দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে কুলসুমের জন্ম নিবন্ধন এবং চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট নেন।
কিন্তু কাগজপত্র নেওয়ার পর চাকরি দেওয়ার পরিবর্তে শফিক তাকে জানান, গত ৫ই আগস্ট আশুলিয়ায় এক যুবক মারা গিয়েছেন এবং কুলসুমকে স্ত্রী সাজিয়ে তারা কুলসুমকে বাদি বানিয়ে আদালতে একটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিয়েছেন।
কুলসুম দাবি করেন, প্রথমে শফিকের এই প্রস্তাবে কুলসুম রাজি না হলেও পরবর্তীতে শফিক ও তার সাথে রুহুল আমীন কুলসুমকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং সরকারের মোটা অঙ্কের আর্থিক সহায়তা পাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মামলাটি দায়ের করতে রাজি করান।
কুলসুম বলেন, "তারা (শফিক এবং রুহুল আমীন) আমার স্বামীর নাম জানতো, কিন্তু বাকি তথ্য তারা জানতো না। যার কারণে মামলায় আল আমীনের নাম ঠিক থাকলেও অন্যান্য তথ্যের কোন মিল ছিল না। তারা মনমতো তথ্য সাজিয়ে মামলাটি দায়ের করিয়েছে।"
তবে, পুলিশ হেফাজতে থাকাবস্থায় কুলসুমের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শফিউদ্দিন এবং রুহুল আমীন।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ অক্টোবর মোসা. কুলসুম বেগম (২১) নামের এই তরুণী তাঁর স্বামী মো. আল আমীন মিয়া (৩৪) হত্যার অভিযোগ এনে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলাটি দায়ের করেন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনকে আসামি করা হয়।
আদালতের নির্দেশে পরে এটি গত ৮ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়া থানায় নথিভুক্ত করা হয়।
মামলায় নিহত ব্যক্তির পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে, নাম-মো. আল আমীন মিয়া (৩৪), পিতা-সুমন মিয়া, মাতা-ভানু বেগম, ঠিকানা-রংপুর বড় বাড়ি, থানা-সদর, জেলা রংপুর।
মামলার আবেদনে দাবি করা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ৫ আগস্ট সকালে বাদী কুলসুমের স্বামী মো. আল আমীন মিয়া মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিকেল ৪টার দিকে আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় বিজয় মিছিলে তিনিও ছিলেন। তবে পরাজয় মেনে না নিতে পেরে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী নির্বিচার গুলি চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তার স্বামী নিহত হন।
আবেদনে আরও বলা হয়, বাদী কুলসুম বেগম অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তার স্বামীর সন্ধান পাননি। পরে আশুলিয়া নারী ও শিশু হাসপাতালের ৬ই আগস্টের এক প্রতিবেদন এবং একটি লাশের ছবি দেখে মৃত ব্যক্তিকে তার স্বামী হিসেবে শনাক্ত করেন এবং পরবর্তীতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে স্বামীর মৃত্যু সংক্রান্ত ছবি এবং ডকুমেন্টস সংগ্রহ করেন এবং পরবর্তীতে আশুলিয়া থানায় মামলা করতে গেলে থানা থেকে তাকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়।