আর কোনো একতরফা নির্বাচন চাই না; সংস্কারের পরই নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ: সিইসি
আর কোনো একতরফা গায়ের জোরের নির্বাচন চাই না বলে মন্তব্য করেছেন নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন।
তিনি বলেন, 'এর আগে একতরফা নির্বাচন করে দেশের বারোটা বাজিয়েছে একটি সরকার। আমরা আর কোনো একতরফা গায়ের জোরের নির্বাচন চাই না। সংস্কারের পরেই নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হবে।'
রোববার (২৪ নভেম্বর) বিকালে রাজধানীর আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য চার নির্বাচন কমিশনারদের মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
এসময় সিইসি বলেন,'জাতীয় প্রত্যাশা পূরণে আমরা কাজ করব। সর্বশক্তি দিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করব। আমার জীবনে কোনো ব্যর্থতা নেই। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অনেক কঠিন কাজ করেছি।'
তিনি আরও বলেন, 'মানুষ এখন ভোটের নামে নাক ছিটকায়, কারণ এতদিন তারা ভোটে দিতে পারেনি। আপনারা [সাংবাদিকরা] লিখেছেন। এখন ভোটারদের আগ্রহ বাড়াতে বা খাস নিয়তে যে কাজ সেটা জানাতে আপনাদের সহযোগিতা লাগবে। আমরা খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকব। কিন্তু ভালো কাজগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরবেন। তাহলে আমরা উৎসাহিত হবো, কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়বে।'
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে কোনটিকে ভাবছেন- সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, 'অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করাটাই এখন আমাদের একমাত্র চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমরা দেখছি।'
এর আগে, আজ দুপুর দেড়টার পর সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম মো. নাসির উদ্দীন এবং চার নির্বাচন কমিশনারকে (ইসি) শপথ পাঠ করান প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
শপথ নেওয়া চার নির্বাচন কমিশনার হলেন—সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, সাবেক যুগ্মসচিব তহমিদা আহমদ এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।
শপথ নেওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, 'আগের নির্বাচন কমিশনররা শপথ ভঙ্গ করেছেন। আমার শপথ ভঙ্গ হবে না। আমি এটাকে নিজের জীবনের জন্য বড় সুযোগ হিসেবে দেখছি, এই দায়িত্বটাকে। অপরচুনিটি টু সার্ভ দ্য নেশন। দেশের মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত, তারা ফ্রি-ফেয়ার ইলেকশনের জন্য অনেক সংগ্রাম করেছে, অনেক আন্দোলন করেছে বিগত বছরগুলোতে। অনেকে রক্ত দিয়েছে, আমি তাদেরকে একটা ফ্রি-ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল ইলেকশন দেয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আই ইউল ডু বেস্ট ফর দ্যট।'
নির্বাচন কমিশন সংস্কার নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু একটা নির্বাচন করতে গেলে কিছু এসেনশিয়াল সংস্কার লাগবে। যেমন, কেউ বলছে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেনটেটিভ পদ্ধতির নির্বাচন, কেউ বলছে আগের পদ্ধতিতে নির্বাচন। সংবিধানে যদি এটির সমাধান না হয়, তাহলে নির্বাচন আমরা করব কীভাবে। এখন নির্বাচন করতে গেলে, আমাদের যে তরুণ প্রজন্ম ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে বছরের পর বছর, তাদেরকে ভোটার লিস্টে আনতে হবে। সুতারাং ভোটার লিস্ট করতে হবে। কোথায় কোথায় সংস্কার দরকার হবে, সেটি আমরা পেয়ে যাব। কারণ নির্বাচন সংস্কার কমিশন কাজ করছে। তাদের পরামর্শ আসুক, আমরা দেখি কোনটা কোনটা গ্রহণযোগ্য হয়। যেগুলো গ্রহণযোগ্য হয়, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। সংবিধান সংস্কার কমিশন কাজ করছে, তাদের অনেক পরামর্শ থাকবে। কন্সটিটিউশন ঠিক না হলে আমাদের যাত্রা এলাপাথাড়ি হয়ে যাবে।'
সিইসি আরও বলেন 'বেশি দিন তো নেই। সরকার বলছে, ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছে। …অতি অল্প সময়। আপনারা আশ্বস্ত থাকেন, আমাদের নিয়ত সহিহ। আর এবারের মতো একটা সুযোগ আগে ছিল না—সেটা হচ্ছে, শুধু আমরাই না, রাজনৈতিক দলগুলো যারা নির্বাচন করবেন, তারা ১৫-১৬ বছর ধরে বলে আসছেন, আমরা ভোটের অধিকার চাই। আমরা অবাধে ভোট দিতে চাই। সুতরাং তাদেরকে আমরা সাথে পাব, তাদের দাবিটা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করব।'
কবে নাগাদ নির্বাচন দেবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, 'দিনক্ষণ নিয়ে এখনই বলা যাবে না। কিছু সংস্কার যেগুলো দরকার আছে, সেগুলো সম্পন্ন করে…আগে আমি দায়িত্ব নিই, বুঝে নিই, কাজ-কর্মটা বুঝে নিই, সেটি তো বুঝতে দেবেন।'
আগের তিন বিতর্কিত নির্বাচন
সাবেক আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচন ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছিল। ওই নির্বাচনগুলোতে ভোট জালিয়াতি, বিরোধী প্রার্থীদের ওপর দমন-পীড়ন এবং সহিংসতার বহু অভিযোগ উঠেছিল।
২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপকভাবে বিরোধী দলের সদস্যদের গ্রেপ্তার, বিরোধী দলের হরতাল ও বিক্ষোভে সহিংসতা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছিল আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। এমনকি শুধু ভোটের দিনেই কমপক্ষে ২১ জন নিহত হয়েছিলেন।
প্রায় সব প্রধান বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করেছিল, যার ফলে ৩০০টি সরাসরি নির্বাচিত আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় জিতে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসে।
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনও সহিংসতার কারণে বিতর্কিত হয়েছিল। বিরোধী রাজনীতিকরা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ওই নির্বাচনকে ভোট জালিয়াতির নির্বাচন বলে বিবেচনা করেছিল। ওই নির্বাচনে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় মহাজোট ২৫৭টি আসন পেয়েছিল।
এছাড়া, এটিকে অনেকেই 'গভীররাতের নির্বাচন'- হিসেবে অভিহিত করেছে। কারণ গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্সগুলোয় ব্যালট ভরে দেওয়া হয়েছিল। যদিও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল, পরবর্তীতে তারা নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছিল।
এ বছরের শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকার আয়োজত সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনটিও সমালোচিত হয়েছে, কারণ বেশিরভাগ প্রধান দল নির্বাচন বর্জন করেছিল। ভোটার উপস্থিতির হারের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন রেকর্ড করেছে।
সাবেক সিইসি প্রথমে দাবি করেছিলেন, তার কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী ভোটর উপস্থিতি ছিল ২৮%, সিইসির এই বক্তব্যের পর দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তবে পরে সেই বক্তব্য থেকে সরে এসে তিনি দাবি করেছিলেন ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪১.৯৯%।
শাসক দল আওয়ামী লীগ ২২৪টি আসন জিতেছিল, আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের সদস্য এবং যাদেরকে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির জন্য ডামি প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল, ৬২টি আসন পেয়েছিল।